ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল। একসময় বরিশালকে চেনাতে এমন বাক্য ব্যবহৃত হতো কিন্তু সেই চিত্র এখন বদলে গেছে। শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া এবং বিভাগের অধিকাংশ জেলা ও উপজেলার খালগুলোর বেশির ভাগই অস্তিত্ব হারিয়েছে। কীর্তনখোলা ও পালরদী নদীও দখল হচ্ছে।
বরিশাল শহরে একসময় ১৮টি বড় খাল ছিল। এসব খালগুলোর মধ্যে অন্যতম বটতলা খাল। শহরের বটতলা থেকে নবগ্রাম হয়ে ঝালকাঠি জেলার রায়পাশা-কড়াপুরে গিয়ে খালটি সুগন্ধা নদীতে মিশেছে। এলাকাবাসী জানান, আশির দশকের মাঝামাঝি সময়েও খালটিতে নৌকা চলাচল করতো। কিন্তু বেশির ভাগ অংশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে এটি মরা খাল। নবগ্রাম এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বেশ কয়েকটিস্থানে খালটির ওপর নির্মিত সরু কালভার্টের দুই পাশের বিরাট অংশ ভরাট হয়ে গেছে। পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খালে থাকা ময়লা-আবর্জনা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
নগরবাসী জানান, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামাল বরিশাল পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময় উন্নয়নের নামে খাল ভরাট শুরু হয়। সে সময় (১৯৯৮ সাল) তৎকালীন পৌরসভা বটতলা এলাকায় বটতলা খাল ভরাট করে দোকানপাট নির্মাণ করে।
২০০০ সালে বরিশাল পৌরসভা সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হলে আহসান হাবিব কামাল কিছুদিন মেয়র ছিলেন। ওই সময় খালটির বটতলা থেকে হাতেম আলী কলেজ চৌমাথা পর্যন্ত অংশ ভরাট করা হয়। ২০০৩ সালে মজিবর রহমান সরোয়ার (বর্তমানে মহানগর বিএনপির সভাপতি) মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর খালের নবগ্রাম থেকে বটতলা মার্কেট পর্যন্ত এলাকা ভরাট করা হয়। বটতলা খালের ওপর সড়ক নির্মাণ করা হয় সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরনের সময়ে।
তবে সাবেক মেয়রগণ বটতলা খাল ভরাটের জন্য পরস্পরকে দায়ী করেন। আহসান হাবিব কামাল বলেন, বটতলা খাল এলাকায় নির্মিত দোকানপাটগুলো ছিলো জেলা পরিষদের। মজিবর রহমান সরোয়ারের দাবি, তার সময়ে বটতলা খাল ভরাট করা হয়নি, বরং খালের পাড়ের ভরাট হওয়া অংশ ও অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এলাকার প্রভাবশালী কতিপয় ব্যক্তির দখল ও দূষণে নাব্যতা হারিয়ে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে কাঁঠালিয়া উপজেলার একসময়ের খরস্রোতা খালগুলো।
দখলকারীদের রাক্ষুসে থাবা থামানো না গেলে খুব শীঘ্রই মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে নদীমাতৃক এ অঞ্চলের অধিকাংশ খাল। সূত্রমতে, ওই উপজেলার মধ্যদিয়ে বহমান থানা সংলগ্ন চৌধুরী খালটি দখল ও দূষণে এখন মরা খালে পরিণত হয়ে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।
স্থানীয় প্রভাবশালী তারেক বুলুর নেতৃত্বে আকন বাড়ির সামনে থেকে খালের একাংশ দখল করে নিয়েছে স্থানীয়রা। খালের দুইপাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিলাসবহুল অট্টালিকা, স্ব-মিল, দোকানপাট।
উপজেলার শৌলজালিয়া ইউনিয়নের সেন্টারের হাট বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে হিজলতলা খাল। সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শত বছরের পুরনো ওই খালের স্লুইজ গেটের ওপর পাকা ভবন নির্মাণ করেছে স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি।
খালের পাড়ে সরকারী জমিসহ খালের ওপরের স্লুইজ গেটের একাংশ দখল এবং অবৈধ ভবন নির্মান করলেও প্রশাসন তা উচ্ছেদ করতে পারছে না।
একইভাবে শৌলজালিয়া ইউনিয়নের প্রভাবশালী মিজানুর রহমান বশির মীরা তার বাড়ির সামনের বৈরাগী বাড়ি খালের প্রায় পাঁচশত ফুট দখল করে মাছ চাষ করে বছরে লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন। ফলে খালের পানি প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় কৃষকদের চাষাবাদ মারাত্মকভাবে ব্যহৃত হচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের চোখের সামনেই সরকারী খাল দখল করে শৌলজালিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মৃত কুদ্দুস মীরের পুত্র মিজানুর রহমান বশির মীরা ও তার ছোট ভাই সৈয়দ শামীম জাহাঙ্গীর মাছ চাষ ও দোকান ঘর নির্মান করছে।
এছাড়া উপজেলার মুন্সিরাবাদ বাজারের সবুরুননেছা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনের সরকারী জমিসহ প্রবাহমান খালের একাংশ দখল করে ৬/৭টি দোকানঘর নির্মান করছে মোঃ পনির, জালাল, খালেক হাওলাদার, ছিদ্দিকুর রহমানসহ স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
উপজেলার পটিখালঘাটা ইউনিয়নের প্রভাবশালী আলাউদ্দিন আল আজাদ বাদল সাবেক চেয়ারম্যান মতি মিয়ার বাড়ি সংলগ্ন খালের প্রায় এক হাজার ফুট দখল করে গড়ে তুলছেন বিলাস বহুল অট্টালিকা। এ ব্যাপারে কাঁঠালিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দিন বলেন, খাল দখল ও দূষণকারীদের কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা। খুব শীঘ্রই উচ্ছেদ অভিযানের মাধ্যমে সরকারী খাল দখল মুক্ত করা হবে।
বরিশালের নদী খাল বাঁচাও আন্দোলনের সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন বলেন, কাগজে-কলমে এখনও শহরে ১৮টি খালের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় সাতটি খালের। এগুলো হলো-জেল খাল, লাকুটিয়া খাল, আমানতগঞ্জ খাল, সাগরদী খাল, নবগ্রাম খাল, পুডিয়া খাল ও টিয়াখালী খাল। খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় সামাস্য বৃষ্টিতেই শহরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে ভাটার খাল, চাঁনমারী খাল, নাপিতখালীর খাল ও শোভারানীর খাল ভরাট করা হয়েছে। খালগুলোকে দখলদারমুক্ত করার আন্দোলনের ফলে ২০০৯ সালের শেষের দিকে যৌথ জরিপকারীদের অনুসন্ধানে কীর্তনখোলা নদী থেকে নথুল্লাবাদ ব্রিজ হয়ে কুদঘাটা পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত জেল খালের দুই কিলোমিটার এলাকায় ৮২ জন দখলদার চিহ্নিত করা হয়েছিলো। সে সময় নদী খাল বাঁচাও আন্দোলনের মধ্যস্থতায় বরিশাল সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং বরিশাল সেচ প্রকল্প (বিআইপি) মিলিতভাবে নগরীর খালের সীমানা নির্ধারণের জন্য জরিপ ও অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের কাজ শুরু করেছিল। উদ্যোগটি সেখানেই থেমে আছে বলে জানিয়েছেন কাজী এনায়েত হোসেন।
এছাড়া গৌরনদীর টরকী বন্দর থেকে উত্তরদিকে বাউরগাতি পর্যন্ত তিন কিলোমিটার খাল বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে (২০০১ সালে) দখল হয়ে গেছে। খালের উপর পাকা-আধা পাকা স্থাপনা নির্মাণ করায় খালের চিহ্নটুকুও হারিয়ে যেতে বসেছে। গৌরনদী বাসষ্ট্যান্ডের গয়নাঘাটা নামক এলাকায় সরকারী খাল দখল করে বিএনপি সরকারের আমলে জামায়াত পরিচালিত আল-আমিন টেকনিক্যাল কলেজের ভবন নির্মান করা হয়েছে।
ফলে বন্ধ হয়ে গেছে গৌরনদী ভায়া চাঁদশী হয়ে আগৈলঝাড়ার রাজিহার পর্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ খালটি। এতে দীর্ঘ কয়েক কিলোমিটার খাল মরে গিয়ে পানির অভাবে কৃষকরা চাষাবাদ করতে না পেরে অনাবাদি জমির পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে বাটাজোর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে পূর্ব দিকে সরিকল পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার খাল ও খালের দুইপাশে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে খাল দখল করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারিহা তানজীন জানান, যেখানেই খাল দখলের খবর পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে। নতুন করে কাউকে খাল দখল করতে দেয়া হবেনা। তিনি আরও জানান, খালের মধ্যে থাকা স্থাপনাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
দখল হচ্ছে নদী ॥
বিআইডব্লিউটিএ’র বরিশাল অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে শুধু বরিশাল নদীবন্দর এলাকায় জরিপ করে কীর্তনখোলা নদীতে ৩৭জন দখলদারকে চিহ্নিত করে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছিলো। পরে নদীতীরের দখল হওয়া জায়গার একাংশে মুক্তিযোদ্ধা পার্ক নির্মাণ করে সিটি কর্পোরেশন। অন্য অংশ দখলদারদের নিয়ন্ত্রণেই রয়ে গেছে। সরেজমিনে শহরের লঞ্চঘাটের বিপরীতে কীর্তনখোলায় জেগে ওঠা রসুলপুর চরকে কেন্দ্র করে নদী ভরাট ও দখলের ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে।
সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮০-এর দশকের দিকে জেগে ওঠা ওই চরের আয়তন ২৫ একর ২৩ শতাংশ। শুরুতে গৃহহীন কিছু মানুষ ওই চরে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, সেই দলের সমর্থনপুষ্ট ভূমিদস্যুরা চর দখল করে নদী ভরাট করে চরের আয়তন বাড়িয়েছেন।
এছাড়া একসময়ের ভয়ঙ্কর পালরদী নদীর দুই তীর দখলের ফলে বর্তমানে পালরদী নদীটি এখন মরাখালে পরিনত হয়েছে। স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা বলেন, পালরদী নদীতে আগে স্টিমার চলাচল করতো, বর্তমানে লঞ্চ চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন থেকে ঢাকা-টরকী নৌরুটের লঞ্চ শেষ গন্তব্যে পৌঁছাতে না পেরে গৌরনদী ও কালকিনি উপজেলার সীমান্তবর্তী কয়ারিয়া এলাকা থেকে যাত্রী পরিবহন করছে।
এ প্রসঙ্গে বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান বলেন, দখল হওয়া নদী ও খাল উদ্ধারের জন্য সরকারীভাবে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। তাই প্রতিটি উপজেলার নির্বাহী অফিসারদের এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেয়ার পর ইতোমধ্যে বেশ কিছু উপজেলায় উচ্ছেদ অভিযানও পরিচালনা করা হয়েছে। বাকিগুলোও পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ করা হবে।