বরিশালে ৬ মাসে ১শত জনের আত্মহত্যা!

লেখক:
প্রকাশ: ১ বছর আগে

শাহরিন রিভানা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি ডিপার্টমেন্টের ১১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। গত ১৬ জুলাই পরীক্ষায় অংশ নেন রিভানা।

এরপর থেকে রিভানার খোঁজ পাচ্ছিল না পরিবার। পরে গত ২০ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার দিকে কর্ণকাঠির আনন্দবাজার এলাকায় ব্যক্তি মালিকানাধীন মোল্লা ছাত্রী নিবাসের একটি কক্ষ থেকে শাহরিন রিভানার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, কক্ষের ফ্যানের সঙ্গে ওড়না দিয়ে ফাঁস নিয়ে রিভানা আত্মহত্যা করেছেন।

রিভানার মতোই আরও অনেক তরুণ-তরুণী আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। বরিশালে ক্রমশ বেড়ে চলেছে আত্মহননের প্রবণতা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে বরিশাল জেলায় ১০০ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। আর আত্মহননকারীদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি।

জেলা পুলিশ ও মেট্রোপলিটন পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত ৬ মাসে বরিশাল জেলায় ৬৬ জন এবং মহানগরে ৩৪ জন আত্মহত্যা করেছে।

এরমধ্যে গলায় ফাঁস নিয়ে বরিশাল জেলায় আত্মহত্যা করেছে ৫২ জন ও বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকায় ১৯ জন। এ নিয়ে মোট ৭১ জন আত্মহত্যা করেছে। আর বিষপান করে বরিশাল জেলায় ১৪ জন আর মেট্রোপলিটন এলাকায় ১৫ জন আত্মহত্যা করেছেন।

এ বিষয়ে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (ক্রাইম, অপারেশন অ্যান্ড প্রসিকিউশন) খান মুহাম্মদ আবু নাসের বলেন, আত্মহননের কারণগুলো খুঁজতে গিয়ে যেসব বিষয় সবচেয়ে বেশি আমাদের সামনে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে যৌতুক, শারীরিক নির্যাতন, মাদক, পেশাগত বিড়ম্বনা এবং আর্থিক সংকট। আরেকটি কারণ হচ্ছে অনলাইন জুয়ায় সর্বস্ব হারিয়ে অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নেন।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম বলেন, মাদকাসক্ত এবং হতাশ ব্যক্তিদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা বেশি।

বিষণ্ন রোগীদের মধ্যে এক ধরনের তীব্র আশাহীনতা তৈরি হয়। আমাদের সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে পারিবারিক বন্ধন এবং ছেলেমেয়েদের মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। পারিবারিক কলহ ও প্রেম-প্রতারণাজনিত কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে।

অবশ্য আত্মহননের প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য সামাজিক অবক্ষয় এবং বিদেশি সংস্কৃতিকেই দায়ী করছে সচেতন মহল। সমাজ বিশ্লেষক ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যখন কোনো ব্যক্তির জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক এবং উপলব্ধি-অনুধাবন শক্তি লোপ পায়, নিজেকে অসহায়-ভরসাহীন মনে করে, তখনই ধর্ম-কর্ম ভুলে মানুষ আত্মহত্যা করে বসে।

প্রচণ্ড মনস্তাত্ত্বিক চাপও আত্মহত্যার পেছনে কাজ করে। আবার জাগতিক দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা ও অপমান থেকে আত্মরক্ষা করতে দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিরা আত্মহননের মধ্য দিয়ে মুক্তি খোঁজে।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মতে, বর্তমানে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মাদক, প্রেমে ব্যর্থতা, পারিবারিক কলহ এবং অতিরিক্ত উচ্চাকাক্সক্ষার কারণে তরুণ-তরুণীরা বেশি হারে আত্মহত্যা করছে।

হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় খারাপ ফল এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়াসহ ছোটখাটো বিষয়েই আবেগতাড়িত হয়ে অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। এর পেছনে রয়েছে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, নির্যাতন, ইভটিজিং, যৌতুক এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা না থাকা ইত্যাদি।

সচেতন নাগরিক কমিটির বরিশাল জেলার সাবেক সভাপতি শাহ সাজেদা বলেন, পরিবারের পাশাপাশি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আত্মহননের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সচেতন করা হলে শিক্ষার্থীরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেবে। পাশাপাশি পরিবার থেকেও ছেলেমেয়েদের বোঝাতে হবে।

আবার অনেকে আছেন সংসারে অভাব-অনটনের কারণে অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। সে ক্ষেত্রে পরিবারের সবাইকে আয় বুঝে চাহিদা মেটাতে হবে। কারও ওপর প্রেশার না দিয়ে তাকে অনুপ্রেরণা দিতে হবে। কাজের মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে।

এ বিষয়ে এক ছাত্রের অভিভাবক মুরাদ আহমেদ বলেন, সবার আগে সন্তানদের সময় দিতে হবে। আমাদের অনেকের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করেন

। সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত আমার সন্তান বাসায় একা থাকে। সন্তানকে আমরা অভিভাবকরা সময় দিচ্ছি না। সে দিনে কী করছে, না করছে সে বিষয়টিও আমরা লক্ষ রাখতে পারছি না। আত্মহননের প্রবণতা কমাতে হলে সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ ও তাদের সময় দিতে হবে।

আরেক ছাত্রীর অভিভাবক সাইফুর রহমান মিরন বলেন, সবার আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। সন্তান কখন কী করছে, কোথায় যাচ্ছে সে বিষয়ে অভিভাবকদের জানতে হবে। সন্তান যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে তা সঠিকভাবে করছে কি না সে বিষয়ে বাবা-মাকে লক্ষ রাখতে হবে।