বরিশালে হুমকির মুখে অতিথি পাখির অভয়স্থল

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

ত মৌসুমে তীব্র শীতের হাত থেকে রক্ষা পেতে শীত প্রধান দেশ থেকে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে বসবার শুরু করে অতিথি পাখির দল। এরই ধারাবাহিকতায় অন্য বছরের চেয়ে এই বছর বরিশাল নগরীর বিবিরপুকুর পাড়ের পূর্ব দিকের অধিক পাখি দেখা যায়।

পাখিদের কিচির-মিচির কলরবে মুখর বরিশাল শহরের অন্যতম সৌন্দর্য পরিসর বিবিরপুকুরের পূর্বপাড়ের পাখির অভয়স্থল নানাভাবেই এখন হুমকির মুখে।

একসময় পরম নিরাপদ স্থান ভেবেই হয়তো শহরের কর্মব্যস্ত এলাকায় পাখিরা এই অভয়স্থল গড়ে তুলেছিল। কিন্তু শহর উন্নয়নের মহড়ায় পুকুরের চারপাশ ঘিরে গড়ে ওঠা বহু হাইরাইজ বিল্ডিং ও এর আলোকসজ্জায় ব্যবহৃত মেটাল হ্যালাইডের উজ্জ্বল আলো, দিনের অধিকাংশ সময়ই রাস্তার যানজটে বাজানো গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন ও যত্রতত্র মাইকের আওয়াজ, আতশবাজি উল্লাস, অতিরিক্ত বিষাক্ত ধোঁয়া সৃষ্টিকারী শব্দবাজির ভয়ের কারণে এখানকার পাখিরা তাদের দীর্ঘদিনের নিরাপদ জায়গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই বিবিরপুকুর পাড়ের বাংলাদেশ টেলি কমিউনিকেশনের দেয়াল ঘেরা অরণ্য শোভিত বিশাল অফিস চত্বরের গাছে গাছে শত শত পাখির আগমন ঘটে। আর তখনই শহরের অন্যতম ব্যস্ত গির্জামহল্লা এলাকা পাখির ডাকে মুখরিত হয়ে ওঠে।

এখানের প্রতিটি গাছের ডালপালায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকে সাদা ও হালকা খয়েরি পালকের অজস্র বক। আর তাতেই যেন বড় বড় গাছের সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে জীবন্ত বকফুল ফুটে থাকার অনন্য দৃশ্য তৈরি হয়। ডালে ডালে দেখা যায় পাখিদের বাসা, কোনো কোনো পাখি বাসায় ডিমে তা দিচ্ছে, আবার কোনো পাখির বাসাতে বাচ্চা ফুটেছে।

সেইসব বাসায় পাখি মা-বাবার মুখ থেকে হাঁ করে খাবার খাচ্ছে ছানাগুলো। শুধু বক নয়, রঙের বৈচিত্র্য ফোটাতেই কি-না, ছোপ ছোপ কিছু কালো পানকৌড়ির দেখাও মেলে উজ্জ্বল সাদা বকের ভিড়ে।

প্রতিদিন বিকেল পড়লেই এই এলাকায় পাখিদের সুরেলা ধ্বনিতে মুগ্ধ হয়ে বহু পথচারি থমকে দাঁড়িয়ে দুদ-পাখিদের ওড়াউড়ি দেখে। পাখি দেখার আনন্দ উপভোগ করতে শিশু, বৃদ্ধ, যুবক-যুবতী অনেকেই আসেন।

সারা বছরই এখানকার পাখির সমারোহ থাকত বলে শহরের দূর-দূরান্ত থেকেও বহু পাখিপ্রেমী ও সৌখিন মানুষও বিবিরপুকুর পাড়ের পাখি সমারোহ দেখতে আসতেন। বরিশালে আসা বহু পর্যটকও শহরের একচিলতে অরণ্যে এত পাখির সমাবেশ দেখে আশ্চর্য হতেন।

সাধারণত সারাবছরই এখাকার বড় বড় মেহগনি, রেইনন্ট্রি, কাঁঠাল, আম এবং চাম্বল গাছের ঝোপঝাড়ের আশ্রয় পেতে ঝুঁট-শালিক, বুলবুলি, বসন্তবৌরি, দোয়েল, বেনেবৌ, কুটুরে পেঁচা, গো-শালিক, কোকিল, কাক, টিয়া, ঘুঘু, বক, চড়ুই, মুনিয়া, মাছরাঙাসহ বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির পাখিরাই এখানে নিয়মিত আসত।

পাখিদের কিচির-মিচির কলরবে মুখর বরিশাল শহরের অন্যতম সৌন্দর্য পরিসর বিবিরপুকুরের পূর্বপাড়ের পাখির অভয়স্থল নানাভাবেই এখন হুমকির মুখে। বরিশালের পলাশপুর ৫নং ওয়ার্ড এর কাজির গোরস্তানের পাশের একটি বাড়িও সন্ধ্যা হলেই পাখির কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত হয়ে উঠে।

বাড়িটি এছাড়াও বরিশালের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর অতিথি পাখি আসতে দেখা গেছে। এর মধ্যে বালি হাঁস, পান কৌরি, সাঁদা বকসহ নাম না জানা বিদেশি অনেক পাখির আগমন ঘটেছে বরিশাল নগরীতে। বিবিরপুকুর পাড়ে অতিথি পাখিদের নজরকারা দৃশ্য উপভোগ করতে অনেক পথচারি কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে পরছেন।

সুন্দর সাদা পাখিগুলোর ছবি তুলে প্রিয়জনকে পাঠাচ্ছেন। আবার কেউ এই ছবিগুলো ফেসবুকে দিয়ে একে অপরকে জানান দিচ্ছেন। শীতের আগমনের সাথে সাথে অতিথি পাখির আসা যেন প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক নিয়ম। গত এক যুগের ব্যবধানে বরিশালে অতিথি পাখির হার আগমন এই বছর অনেক বেশি।

কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত বরিশাল নগরীর বিবির পুকুর পাড়। অতিথি পাখিদের নিয়া কাজ করেন। বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি সভাপতি নজরুল বিশ্বাস বলেন, মূলত অক্টোবরের শেষ ও নভেম্বরের প্রথম দিকেই অতিথি পাখিরা বাংলাদেশে আসে। তবে প্রায় অনেক দিন বরিশালে এই পাখি দেখা যায়নি। এই বছর বরিশালে যে পরিমাণে পাখির দেখা গিয়েছে, তা অন্য বছরের চেয়ে অনেক বেশি।

তাই আমাদের সকলের উচিত পাখি নিধন বন্ধ করা। তাহলে ভবিষ্যতে বরিশালে অতিথি পাখির সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আমি মনে করি। তবে এই অতিথি পাখি আবার মার্চের শেষ দিকে ফিরে যায় আপন ঠিকানায়।

বরিশাল সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট (গোপনীয় শাখা/ শিক্ষা ও কল্যাণ) সুব্রত বিশ্বাস দাস বলেন, অতিথি পাখি কমে যাওয়ার মূল কারণ হলো জনসচেতনতার অভাব।

শিকারিরাও এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবহিত নয়। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ অনুযায়ী পাখি শিকার, হত্যা, আটক ও ক্রয়-বিক্রয় দনীয় অপরাধ।

যার শাস্তি দুই বছর কারাদণ্ড এবং দুই লাখ টাকা জরিমানা। আর আমরা যার যার অবস্থান থেকেই পারি, এসব বিষয়ে সবাইকে সচেতন করতে। অতিথি পাখিদের জন্য একটু ভালোবাসা আর একটু সচেতনতাই পারে আমাদের দেশ বরিশালসহ পুরো বরিশালে অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত করে রাখতে আমাদের সকালের এক হয়ে কাজ করতে হবে।

বরিশালের বন বিভাগে কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন জানান, পৃথিবীতে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি প্রজাতির পাখি রয়েছে। এসব পাখির মধ্যে অনেক প্রজাতিই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় অন্য দেশে চলে যায়।

শুধু ইউরোপ আর এশিয়ায় আছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পাখি। কিছু কিছু পাখি তাই প্রতি বছর ২২ হাজার মাইল পথ অনায়াসে পাড়ি দিয়ে চলে যায় দূর দেশে।

উত্তর মেরু অঞ্চলের এক জাতীয় সামুদ্রিক শঙ্খচিল প্রতি বছর এই দূরত্ব অতিক্রম করে দক্ষিণ দিকে চলে আসে। আমাদের দেশে অতিথি পাখিরা অতটা পথ পাড়ি না দিলেও, তারাও অনেক দূর থেকেই আসে। বরফ শুভ্র হিমালয় এবং হিমালয়ের ওপাশ থেকেই বেশির ভাগ অতিথি পাখির আগমন ঘটে।

এসব পাখি হিমালয়ের পাদ দেশে অবস্থিত তিব্বতের লাদাখ থেকে সেন্ট্রাল এশিয়ান ইন্ডিয়ান ফ্লাইওয়ে দিয়ে প্রবেশ করে। এছাড়া ইউরোপ, দূরপ্রাচ্য (যেমন সাইবেরিয়া) থেকেও এসব পাখি আসে।

পাখির মধ্যে বাংলাদেশের অতি পরিচিতি অতিথি পাখি নর্দান পিনটেইল। এছাড়া স্বচ্ছ পানির বালি হাঁস, খয়রা চকাচকি, কার্লিউ, বুনো হাঁস, ছোট সারস পাখি, বড় সারস পাখি, হেরন, নিশাচর হেরন, ডুবুরি পাখি, কাদাখোঁচা, গায়ক রেন পাখি, রাজসরালি, পাতিকুট, গ্যাডওয়াল, পিনটেইল, নরদাম সুবেলার, কমন পোচার্ড, বিলুপ্ত প্রায় প্যালাস ফিস ঈগল (বুলুয়া)।

এছাড়াও নানা রঙ আর কণ্ঠ বৈচিত্র্যের পাখিদের মধ্যে রয়েছে ধূসর ও গোলাপি রাজহাঁস, লেঞ্জা, চিতি, সরালি, বালু হাঁস, পাতিহাঁস, বুটিহাঁস, বৈকাল, নীলশীর চখাচখি, গিরিয়া, খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগি, নর্থ গিরিয়া এসে থাকে।

বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি স্বপন খন্দকার বলেন, অতিথি পাখিদের বিচরণ নিরাপদ করার জন্য অতিথি পাখি ছাড়াও বক, ঘুঘু বিক্রয় বন্ধ করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পাখি শিকার ও বিক্রয় বিরোধী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করার পাশাপাশি পরিকল্পিত বনায়ন, জলাভূমি ও জলাশয়গুলো সংস্কার করে অতিথি পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে হবে।

তাহলেই দিন দিন আমাদের দেশে অতিথি পাখিদের ভিড় বৃদ্ধি পাবে। বরিশালে যে উপকারী অতিথি পাখি শীতের অতিথি পাখিগুলো আমাদের দেশে এসে সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত করার পাশাপাশি আমাদের যথেষ্ট উপকার করে।

তাই অতিথি পাখিগুলোকে অতিথির মর্যাদা দেয়া উচিত। প্রকৃতির ক্ষতিকর পোকা-মাকড়, কীটপতঙ্গ, ইঁদুর খেয়ে ওরা ফসলের ও জলজ প্রাণীর সুরক্ষা করে।

কিছু পাখি প্রাণী ও উদ্ভিদের বংশ বিস্তারে সাহায্য করে। গাছের ডালে আশ্রয় নেয়া পাখিগুলো গাছের ফাঁকে ফাঁকে থাকা পোকামাড়ক ধরে খায়। ফলে গাছপালা পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।

হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল ও জলাশয়ে পাখিগুলো সাঁতার কাটায় পানিতে অক্সিন মেশার সুযোগ পায় এবং পানির ভারসাম্য রক্ষা পায়। পানিতে মাছের ক্ষতিকর পোকা ধরে খায়। এতে মাছের বংশ রক্ষা পায়। তা ছাড়া পাখির মলমূত্র, বিষ্ঠা মাটিতে জমা হয়ে মাটিকে ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ করে।

পাখি ও মৎস্যবিদদের মতে, যে হাওরে যত বেশি পাখি মুক্তভাবে বিচরণ করবে সে হাওরে বা জলাশয়ে মৎস্যসম্পদ বেশি উৎপন্ন হবে। পৃথিবীর ৮০ শতাংশ পাখিই পোকা খাওয়া পাখি।

এই পাখিরাই পোকা-মাকড় খেয়ে আমাদের মূল্যবান বন-জঙ্গলের বৃক্ষসম্পদগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আমরা এত ব্যাপক পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার করছি যে, আমাদের চার পাশ থেকে এখন পোকা-মাকড় বিলুপ্ত হয়ে আজ নানা প্রজাতির পাখিও বিলুপ্ত হতে চলেছে।

পাখি বিশেষজ্ঞ ও সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি প্রফেসর শাহ সাজেদা বলেন, এটা শুধু আমাদের দেশেরই সমস্যা নয়, সারা পৃথিবীর সমস্যা। গত ২৫ বছরে পৃথিবী থেকে ৮০ শতাংশ পোকা-মাকড়, কীটপতঙ্গ শেষ হয়ে গেছে।

তো, ৮০ শতাংশ পোকা শেষ হয়ে গেলে পাখি কী খেয়ে বেঁচে থাকবে? মানুষ ও পরিবেশের জন্য কীটনাশক অত্যন্ত বিষাক্ত। পতিত জমিকে প্রাকৃতিক অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখা। কিছু ঘাস, কিছু লতাগুল্ম যে স্থানে রয়েছে, সেখানেও তো পাখি থাকে।

সেই পতিত জমিটুকুও তো নেই। বরিশালে সুরক্ষিত হোক অতিথি পাখির বিচরণক্ষেত্র সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের সাথে অতিথি পাখিদের হৃদয়ের সম্পর্ক অনেক গভীর ও প্রাচীন। ‘আমাদের সচেতনতার অভাবে বা শখের কারণে আমরা শীতের পরিযায়ী পাখিদের শিকার করে মেরে ফেলছি।

এতে আমরাই আমাদের এই সুন্দর বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছি। পাখিরা নিজ আবাস ভূমি ছেড়ে চলে আসে। সেই পাখিগুলোর বেশির ভাগই আবার তাদের নিজ ভূমিতে শীত শেষে ফিরে যেতে পারে না এক শ্রেণীর অর্থলোভী পাখি শিকারীদের অত্যাচারে। এটা খুবই মর্মদায়ক।

তিনি বলেন, মানুষের সৃষ্ট কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষ নিজেদের স্বার্থের কারণে নির্বিচারে বন-জঙ্গল, পাহাড়, টিলা কেটে সাবাড় করে পশুপাখির আবাসস্থল ধ্বংস করে দিচ্ছে।

তার প্রতিক্রিয়ার ফল প্রকৃতির ওপর পড়ছে। তাই মানবসমাজ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রকৃতি তার ক্ষতির প্রতিশোধ নিতে কাউকে রেহাই দিবে না।

যেহেতু প্রকৃতির বড় একটি উপাদান পাখিসমাজ। তাই আমাদের দেশীয় পাখি কিংবা অতিথি পাখি বা পরিযায়ী পাখিই বলি না কেন, তাদের রক্ষা করতে হবে। তাদের বিচরণক্ষেত্র সুরক্ষা করতে হবে। মুক্ত আকাশে উড়া খালে, বিলে, হাওর-বাঁওড়ে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে তার ব্যবস্থা অবশ্যই আমাদের করতে হবে।

এদিকে, দীর্ঘ ১৪ বছর পর বরিশালের ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দিঘিতে পাখা মেলেছে অতিথি পাখি। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে বরিশাল বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা এলাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরা এই দিঘি।

সময়ের সাথে সাথে এটিকে প্রাকৃতিক আলপনা দিয়ে সাজানোর কাজ যতই এগিয়ে চলছে ততই পর্যটক ও দর্শনার্থীরা আকৃষ্ট হচ্ছেন। আর এই পাখি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রায় ২৪০ বছরের পুরনো দিঘিটি দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হচ্ছে।

যদিও গত এক যুগেরও বেশি সময় এমন চিত্র দেখেনি স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকরা। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের পঞ্চদশ রাজা শিবনারায়নের খনন করা ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দিঘিতে শীতের সময় আসা বিদেশি পাখিদের অবাধ বিচরণে সাধারণ মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করতো।

তবে ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকে এখানকার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। স্থানীয়দের মতে সিডরের সময় ত্রাণ নিয়ে হেলিকপ্টার আসার কারণে ভয়ে চলে গেছে দিঘির অতিথি পাখিরা।

স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, অপরিকল্পিতভাবে মেহেগনিসহ বেশকিছু গাছ লাগানোতে পাখির বিচরণ কমেছে দিঘিটিতে। তাদের মতে মেহেগনিসহ ওইসব গাছ এমন ধরনের যে তাদের নিচে বা কাছাকাছি অন্য কোনো গাছ তেমন একটা হয় না।

এমনকি মেহেগনির ফলও পাখিরা খেতেও চায় না। প্রাকৃতিক কারণে তাপমাত্রার পরিবর্তন ও খাদ্য সংকটের কারণেই দুর্গাসাগরে গত কয়েক বছরে পরিযায়ীদের দেখা মেলেনি, বিশেষ করে শীতকালে ভিনদেশি পাখির অস্তিত্বও দেখা যায়নি। আবার দুর্গাসাগরের পাশের আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে চলাচলরত যানবাহনের শব্দ এবং চোরাগুপ্তা শিকারকেও দায়ী করছেন কেউ কেউ।

যদিও এক যুগ পরে দেশীয়ও প্রজাতির পাশাপাশি শীতকালীন অতিথি পাখির কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত দুর্গাসাগর দেখে অনেকই হতবাক হচ্ছে। চারিদিকে সবুজে ঘেরা এ দিঘি দেখতে আসা দর্শনার্থীরা মুগ্ধ।

তারা দিঘিকে আরো পাখিবান্ধব করার দাবি জানিয়েছেন। আর অতিথি পাখির স্থায়ী বিচরণের জন্য দুর্গাসাগরে পাখিবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, সময়ের সাথে সাথে উন্নয়ন ও পরিকল্পনার অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়া দুর্গাসাগর দিঘিকে কয়েক বছর পরে সতেজ করার উদ্যোগ নেয় জেলা প্রশাসন।

এর ধারাবাহিকতায় বরিশাল জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দার ও প্রাণিবান্ধবভাবে দিঘির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ানোর প্রতি জোড় দেন। দিঘির পাড়ের গাছে মাটির হাড়ি বসানোসহ পাখিবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করেন। নতুন করে দিঘির পাড়ে ফলজ গাছ রোপন, দিঘির দক্ষিণ পাশে পদ্ম আর শাপলা ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সেই সাথে দিঘিতে পুঁটি, মহাশোলসহ দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের প্রচুর পরিমাণে মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়। আর পাখিদের আকৃষ্ট করার জন্য দিঘিকে ঘিরে শত শত হাঁস ও কবুতর পালনও শুরু করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরই প্রথম দুর্গাসাগর দিঘিতে পরিযায়ীদের বিচরণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দাসহ পর্যটকরা।

তারা জানান, দিঘির যেখানে শুধু পরিষ্কার পানি সেখানে পাখির দেখা মিলবে না। তবে দিঘির যে অংশে পদ্ম ও শাপলা রয়েছে, সেখানে প্রচুর পাখি থাকছে। পদ্ম আর শাপলার মধ্যে বসে চোখের আড়াল হয়ে যায় পাখিগুলো।

হঠাৎ করে কেউ গেলে বুঝতে পাবে না যে, সেখানে পাখি রয়েছে। তবে যখন সেখান থেকে একঝাক পাঁখি উড়তে শুরু করে, তখন মুগ্ধ-বিমোহিত হন দর্শনার্থীরা। স্থানীয় বাসিন্দা হাছান মাহমুদ জানান, মূলত পদ্ম ও শাপলা খাবারের সন্ধান দিচ্ছে পাখিদের।

সেজন্য অতিথি পাখিরা দিঘির ওই অংশে থাকছে। বর্তমানে দুর্গাসাগরের পরিবেশ যেভাবে নিরাপদ করা হয়েছে, সেভাবে থাকলে পরিযায়ীরা নিজেদের নিরাপদ মনে করবে এবং শীতের সময় প্রতি বছরই তারা আসবে।

আর পরিবেশের উন্নতি ঘটায় এখানে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন পাখির বিচরণও এখানে বেড়েছে। পাখি থাকলে পর্যটকরা আগের মতো দুর্গাসাগরের প্রতি আকৃষ্ট হবে। আর কৃষিনির্ভর এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের নতুন উন্নয়ন ঘটবে পর্যটন বিকাশের মধ্য দিয়ে।

পর্যটক আরিফ হোসেন জানান, বরিশালে ঘুরে বেড়ানোর মতো তেমন কোনো জায়গা নেই। তবে দুর্গাসাগর একটি ঐতিহ্যের প্রতীক। সিডরের পর পরিবার নিয়ে সেখানে ঘুরতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।

বিশেষ করে স্থানীয় বখাটেদের উৎপাত এবং বিশ্রামাগার ও টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায়ও ভোগান্তি বাড়িয়েছে। তবে এখন পরিবেশ অনেক সুন্দর হয়েছে। সিসি ক্যামেরা দিঘির পরিবেশকে নিরাপদ করেছে। সেই সাথে গোটা দিঘি ঘিরে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এছাড়া দিঘিতে বোট, তীরে ছাতা, টয়লেট, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা পর্যটকবান্ধব সিদ্ধান্ত। আবার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফেরার পাশাপাশি পাখির বিচরণও বেড়েছে, যা ধরে রাখা উচিত।

তবে চলাচলের অভ্যন্তরীন রাস্তায় কিছুটা সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব দিকের রাস্তার বেশ কিছু অংশ ভাঙ্গা এবং জঙ্গলে পরিপূর্ণ। এগুলো পরিষ্কার করলে দুর্গাসাগর দিঘিতে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীরা শঙ্কাহীনচিত্তে আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন।

এ ব্যাপারে বরিশাল জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন হায়দার বলেন, একযুগ পর ফিরে আসা পাখির অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

বিশেষ করে প্রচুর পরিমাণের শামুক ছাড়া হয়েছে এই দিঘিতে। পাশাপাশি কুমিল্লা ও যশোর থেকে লাল, সাদা ও নীল পদ্ম এনে এই দিঘিতে লাগানো হয়েছে। একইভাবে সাদা, লাল ও নীল শাপলা লাগানো হয়েছে।

এছাড়া দিঘির যে প্রান্তে পাখি বেশি বিচরণ করে, সেখানে মানুষের যাতায়াত কমিয়ে দেয়া হয়েছে। গাছে গাছে ঝুঁলিয়ে দেয়া হয়েছে হাড়ি। যাতে করে শুধু বিদেশি পাখিই নয়, নানা প্রজাতির দেশি পাখিও এখানে আসতে পারে। বরিশালে যেসব জায়গায় অতিথি পাখিরা এই শীতে এসেছে, সেসব জায়গা রক্ষা করা হবে।