বরিশালে সতর্ক থাকতে হয় আবহাওয়া অফিসটিকেই !

লেখক:
প্রকাশ: ৪ years ago

উপকূলীয় মানুষের রক্ষাকবচ বিভাগীয় শহর বরিশালের আবহাওয়া অফিসটি ধুঁকছে জরাজীর্ণতায়। লোকবল ও আবাসন সংকট, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সরবরাহে অব্যবস্থাপনা ও সংস্কারবিহীন অফিসটি দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। ফলে সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব কবলিত নাগরিকরা।

 

 

সিডর, আইলা, আম্পান, বুলবুল, ফনী, মোরা, রোয়ানু, কোমেন, মহাসেনের মতো আলোচিত ও ভয়ঙ্কর সব সুপার সাইক্লোন এশিয়া মহাদেশের যে অঞ্চলেই আঘাত হেনেছে, তার প্রভাব এসে আছড়ে পড়েছে বাংলার শস্যভাণ্ডার খ্যাত বরিশাল বিভাগে। ভৌগলিক অবস্থান অনুসারে বঙ্গোপসাগর লাগোয়া এই বিভাগের প্রধান বৈশিষ্ট্য নদীমাতৃকতা। তাই তো দুর্যোগের সবচেয়ে খারাপ প্রভাবের মুখোমুখি হয় এ বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চল।

 

 

ফলে আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করে ও সখ্যতা রেখেই বাঁচতে হয় মানুষকে। নদীতীরবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকা যেমন রোদ-ঝড়-বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে তেমনি বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়াও নির্ভর করে আবহাওয়া অফিসের সংকেতের ওপরে। মূলত আবহাওয়ার সতর্কতা না পেলে এই অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে বোঝাপড়া করে টিকে থাকতেও পারেন না।

 

 

অথচ মানুষকে সতর্ক করবে যে আবহাওয়া অফিসটি, হাজারো সংকটে-ঝুঁকিতে থাকায় নিজেকেই সতর্ক রাখতে হচ্ছে সদা সর্বদা।

 

 

বিভাগের চারটি আবহাওয়া স্টেশনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় বিভাগীয় অফিসটি থেকে। স্টেশনগুলো স্থাপিত হয়েছে উপকূলীয় পটুয়াখালী জেলা সদর ও খেপুপাড়া উপজেলা, দ্বীপজেলা ভোলা এবং বরিশাল জেলায়। উপকূলীয় অন্য দুটি জেলা বরগুনা ও পিরোজপুর এবং মধ্য উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠিতে নেই আবহাওয়া স্টেশন।

 

 

ফলে ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার মানুষ সুদূর বরিশাল বিভাগের আবহাওয়া অফিস থেকে তথ্য জেনে থাকেন। বৈরি আবহাওয়ায় অনেক সময় বাকি তিনটি আবহাওয়া স্টেশনে সংযুক্ত মানুষ তথ্য না পেলে পুরো বিভাগের প্রায় এক কোটি জনসংখ্যাকে নির্ভর করতে হয় বরিশাল বিভাগীয় আবহাওয়া অফিসের ওপরে। কিন্তু সেই অফিসেই বিদ্যুৎ সংকট, সৌর বিদ্যুতের অভাব ও আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকা ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

 

 

সরেজমিনে দেখা গেছে, বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার বরিশাল-লাখুটিয়া সড়কে অবস্থিত আবহাওয়া অফিসটি যে ভবনে স্থাপিত, সেটি স্বাধীনতার আগে ১৯৬৩ সালে নির্মিত হয়। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে গেছে ভবনের সক্ষমতা। ভবনের অধিকাংশ স্থান থেকে খসে পড়েছে পলেস্তরা। দরজাগুলো ভেঙে যাওয়ায় বেধে রাখা হয়েছে কোনোমতে।

 

 

বিভাগীয় আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বশির আহম্মেদ বলেন, ‘আমরা নতুন ভবন বরাদ্দ পাওয়ার চেষ্টা করছি। এজন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। আশা করি, অনতিবিলম্বে বরিশাল আবহাওয়া অফিসের উন্নয়নে বরাদ্দ পাওয়া যাবে।

 

 

আবহাওয়া অফিসটিতে বর্তমানে ১২ জন কর্মরত রয়েছেন। দ্বায়িত্বরত ওই ১২ জনই কর্মকর্তা। যাদের মধ্যে একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, একজন সহকারী ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পাঁচজন উচ্চ পর্যবেক্ষক এবং পাঁচজন বেলুন মেকার। দেশের অন্য বিভাগীয় অফিসে সাধারণত জনবল কাঠামোতে রয়েছে একজন উপ-পরিচালক, দুইজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, একজন সহকারী ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পাঁচজন উচ্চ পর্যবেক্ষক, পাঁচজন বেলুন মেকার, দুইজন অফিস সহায়ক ও নাইট গার্ড। অর্থাৎ এখনো পাঁচজন জনবলের প্রয়োজন।

 

 

অফিস সহায়ক ও নাইট গার্ড ছাড়া পুরোপুরি অরক্ষিত থাকছে বিভাগীয় আবহাওয়া অফিসটি। দায়িত্বরতদের জন্য নেই আবাসনের ব্যবস্থা। সম্প্রতি আবাসনের জন্য একটি ভবনের ব্যবস্থা করা হলেও তা বর্তমান জনবলের জন্যও অপ্রতুল। ফলে কর্মকর্তাদের ভাড়া বাসায় থাকতে হচ্ছে।

 

ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বশির আহম্মেদ বলেন, ‘সংকট থাকলেও আমরা সার্বক্ষণিক চেষ্টা করছি আবহাওয়ার সর্বশেষ তথ্য সরবরাহ করতে। তবে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, যেগুলোর উত্তরণ ঘটানো উচিত।

 

 

‘যেমন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও ইন্টানেট সেবা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের চালিকাশক্তি। কিন্তু বরিশাল বিভাগীয় আবহাওয়া অফিসে ইন্টানেট ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সমস্যা কাটছেই না। যদিও সরকারি ইন্টারনেট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের। কিন্তু কবে নাগাদ বিটিআরসির ব্রডব্যান্ড কানেকশন পাবো, তা এখনো নিশ্চিত নই।

 

 

উচ্চ পর্যবেক্ষক আব্দুল কুদ্দুস বাবুল বলেন, ‘বর্তমানে আবহাওয়ার সংকেত দিতে দুই ধরনের তথ্যের সমন্বয় করা হয়। প্রথমত রাডার ভিত্তিক ওয়েবসাইটের তথ্য এবং দ্বিতীয়ত আমাদের অফিসের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সরঞ্জামাদির ব্যবহারিক তথ্য। কিন্ত এখানকার ইন্টারনেট অত্যন্ত ধীরগতির হওয়ায় তাৎক্ষণিক তথ্য সমন্বয় করে কেন্দ্রীয় আবহাওয়া অফিসে সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হয়। এ অফিসে এখনো মডেম ব্যবহার করে ইন্টারনেট সংযুক্ত হতে হয়। এতে ২-জি গতিসীমা পাওয়া যায়।

 

 

‘ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কানেকশন পেলে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণে সুবিধা হবে এবং তাৎক্ষণিক তথ্য সরবরাহ করা যাবে। আবার ব্যবহারিক সরঞ্জাম পর্যবেক্ষণে বৈদ্যুতিক আলো অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু অফিসে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই, সংযোগ নেই বিদ্যুতের একাধিক লাইনেরও। ফলে বিদ্যুৎ চলে গেলে অফিসে মোমের আলোয় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের কাজ করতে হয়।

 

 

তিনি বলেন, ‘আবহাওয়া অফিস এলাকায় ১৩টি বিদ্যুতের লাইটপোস্ট রয়েছে, যেখানে সিটি করপোরেশনের বাতি সরবরাহ করার কথা থাকলেও তারা না দেওয়ায় আবহাওয়া অফিসে কর্মরতদের বেতনের টাকায় লাইটপোস্টে বাতি জ্বালাতে হয়।’