বরিশালে রেলসংযোগ না থাকার দুর্নাম ঘোচাতে চায়

:
: ৫ years ago

অনলাইন ডেস্ক : ছোটবেলায় স্কুলে যখন শিক্ষকদের কেউ ছাত্রদের প্রশ্ন করতেন- বল তো কোন জেলায় রেললাইন নেই, তখন অবধারিত উত্তর আসত- বরিশাল জেলায়। বরিশালের বিভিন্ন মহকুমা তখনও জেলা হয়নি।

পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে পটুয়াখালী জেলা হলেও বহুদিন পর্যন্ত বরিশাল জেলার অন্তর্ভুক্ত বলেই অধিকাংশ মানুষ মনে করত। পাকিস্তান আমলে টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ময়মনসিংহের অন্যান্য অঞ্চলে রেলসংযোগ থাকায় টাঙ্গাইল জেলায় রেললাইন নেই কেউ বলত না বা স্কুলের পাঠ্যপুস্তকেও লেখা হতো না। পাকিস্তানের শেষ ভাগে টাঙ্গাইল জেলায় উন্নীত হলে রেলসংযোগের ব্যাপারে তার ভাগ্যও বরিশালের মতো দাঁড়ায়।

তবে বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেললাইন স্থাপিত হলে টাঙ্গাইলে রেললাইন না থাকার দুর্নাম ঘোচে। টাঙ্গাইল এখন রীতিমতো রেলপথে সংযুক্ত। উত্তরবঙ্গগামী সব ট্রেনই টাঙ্গাইলের উপর দিয়ে চলে।

বাংলাদেশ হওয়ার পর অবশ্য বরিশালে রেললাইন না থাকার দুর্নাম ঘোচানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের প্রচেষ্টায় ফরিদপুর থেকে বরিশাল পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেয়া হয়।

ওই রেললাইন কোন দিক দিয়ে যাবে সেই এলাইনমেন্ট ঠিক করে জমিও অধিগ্রহণ করা হয়; কিন্তু পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু ও সেরনিয়াবাত উভয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করলে বরিশালে রেললাইন সংযুক্ত করার উদ্যোগ থেমে যায়। কেবল রেললাইন নয়, বরিশালের বিমানবন্দর, যা আমার প্রয়াত পিতা সাবেক স্পিকার বিচারপতি আবদুল জব্বার খানের উদ্যোগে স্টল (short takeoff and landing) বিমানবন্দর হিসেবে চালু হয়েছিল; সেটাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান পটুয়াখালীতে নতুন বিমানবন্দর করার পদক্ষেপ নেন।

সেই লক্ষ্যে জমি অধিগ্রহণ ও ভরাট করার কাজও শুরু হয়। ঢাকা-বরিশাল সংযোগকারী হাইওয়েতে শিকারপুর-দোয়ারিকা সেতু নির্মাণের জন্য বরাদ্দকৃত কুয়েত ফান্ড জিয়ার অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান কেটে সিলেট নিয়ে যান। এ অবস্থায় সেদিন পর্যন্ত বরিশালের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নদীপথই ছিল একমাত্র ভরসা। সেই নদীপথে ড্রেজিং না হওয়ার ফলে মাঝেমধ্যে চর পড়ায় নদীপথের বাহন লঞ্চ ও স্টিমার আটকে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঝড়, চর আর কুয়াশা বরিশাল যাতায়াতকারী মানুষের মাথাব্যথার কারণ ছিল।

১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়ে বরিশালের সঙ্গে আকাশ, রেল ও নৌপথের যোগাযোগের ব্যাপারে বিমানবন্দরকে সম্প্রসারিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠা, রেলের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমির উন্নয়ন করে ফরিদপুরের মধুখালী স্টেশন থেকে বরিশাল পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ এবং বরিশালের নৌপথকে নাব্য রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং করার জন্য সংসদের বিভিন্ন অধিবেশনে প্রশ্ন করি, সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের নোটিশ দেই, বাজেট আলোচনায় তুলে ধরি। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের কার্যবহ রিপোর্টে এসব বিষয় লিপিবদ্ধ আছে।

বরিশালের রহমতপুরের ‘স্টল’ বিমানবন্দরটি পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দরে রূপান্তরিত করার জন্য সেসময়ের বরিশাল পৌরসভার চেয়ারম্যান ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করি; কিন্তু তিনি পটুয়াখালীতে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের বিষয়ে তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। পরবর্তী সময়ে রহমতপুরের ওই বিমানবন্দরের জমি যাতে ডি-রিকুইজিশন করার উদ্যোগ নেয়া হয় সেটাও সে সময়ের সচিব ও পরবর্তীকালের মন্ত্রিপরিষদ সচিব ঝালকাঠির মুজিবুল হককে দিয়ে ঠেকিয়ে দেয়া হয়।

এখানে ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ এসে গেলেও যেটা বলার তা হল রেলসংযোগ তো বটেই, সব ধরনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে বরিশাল- যা এখন পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও ভোলা নিয়ে বৃহত্তর বরিশাল- চরমভাবে অবহেলিত থেকেছে।

সেই অবহেলা এখন দূর হয়ে গেছে এটি মনে করার কারণ নেই। তবে স্বস্তি ও আশার কথা- রহমতপুর বিমানবন্দর এখন পরিপূর্ণ বিমানবন্দর এবং প্রতিদিন ওই বিমানবন্দরে একটি হলেও ফ্লাইট ওঠানামা করে। বরিশালের নৌপথে নিয়মিত ড্রেজিং করা হয় এবং বরিশাল লঞ্চঘাটকে একটি আধুনিক ও মনোরম লঞ্চঘাটে উন্নীত করা হয়েছে।

রেলসংযোগের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের আশাবাদ জন্ম নিয়েছে। নবম জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে করা রেলসংযোগ সম্পর্কিত একটি প্রশ্নের সম্পূরক হিসেবে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ভাঙ্গা পর্যন্ত যখন রেললাইন আসছে, সেটা বরিশাল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে কিনা। তিনি ইতিবাচক উত্তর দিয়ে সহাস্যে আশ্বস্ত করেছিলেন।

শেখ হাসিনা সরকার সৃষ্ট রেলপথ মন্ত্রণালয় দেশে রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণের জন্য যে মাস্টারপ্লান নিয়েছে তাতে ‘ঢাকা-মাওয়া-জাজিরা-ভাঙ্গা-বরিশাল করিডোরে’র কথা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। আরেকটি করিডোর স্থাপিত হবে ‘ঢাকা-মাওয়া-জাজিরা-ভাঙ্গা-কাশিয়ানি-গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া’ পর্যন্ত। কেবল তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, এ রেললাইন বরিশাল থেকে পটুয়াখালী হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত যাবে। সে মর্মে কী কাজ শুরু হয়েছে জানা নেই। তবে এটি স্বাভাবিক যে, পায়রা বন্দর পূর্ণাঙ্গ বন্দরে রূপ নিলে ওই বন্দরের প্রয়োজনেই মোংলার মতো পায়রা পর্যন্ত রেলসংযোগ স্থাপিত হবে।

এ আশাবাদ একটু থমকে যায় এই ভেবে যে, তাহলে কি ঝালকাঠি, পিরোজপুর, ভোলা রেলসংযোগের এ সুযোগের বাইরে থাকবে? যতদূর জানা গেছে, রেলপথ মন্ত্রণালয় দক্ষিণবঙ্গের এসব অঞ্চলকে রেলসংযোগে আনার জন্য সমীক্ষা করছে অথবা করবে। আর প্রধানমন্ত্রী তো ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, দেশের সব জেলা সদরকে রেলসংযোগের আওতায় আনতে হবে।

এ ক্ষেত্রে পিরোজপুর একটু advantageous জায়গায় আছে। ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণ ইতিমধ্যেই মাস্টারপ্লানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ওই টুঙ্গিপাড়া থেকে গোবরা হয়ে পিরোজপুর পর্যন্ত রেললাইন টানা খুব বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। রেলপথ মন্ত্রণালয় সেই লক্ষ্যে একটি সমীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায়। বর্তমান সরকার রেলসংযোগ ক্ষেত্রে যে বিপ্লব সাধন করছে, তাতে এটি হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের পাশাপাশি পিরোজপুরের নেতারা ও সাধারণ মানুষের উদ্যোগও জরুরি।

প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনা রেলসংযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছেন। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। গ্রহণ করা হচ্ছে নানা প্রকল্প। দক্ষিণ বাংলার মানুষ তার ওই বিপ্লবের সহযাত্রী হতে চায়।

রাশেদ খান মেনন : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী