বরিশালে বাস দুর্ঘটনা: ৬০ কিলোমিটার দূর থেকে এসে স্বামীকে হাসপাতালে নিলেন স্ত্রী

লেখক:
প্রকাশ: ২ years ago

ভোর ৫টায় স্বামী দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন শুনে ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল নিয়ে ৬০ কিলোমিটার দূর থেকে ছুটে আসেন স্ত্রী। ঘটনাস্থলে এসে দেখেন আহত অবস্থায় পড়ে আছেন স্বামী।তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে চিকিৎসা না পেয়ে স্বামীকে নিয়ে ছুটে যান বরিশালে। সবশেষে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা নিশ্চিত করেন।

স্বামীর প্রতি ভালোবাসা ও সাহসিকতার এমন দৃষ্টান্ত রেখেছেন পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার ধাওয়ার রাজপাশা গ্রামের মরিয়ম বেগম। শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্বামীর পাশে বসেই পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এই নারী। একই সঙ্গে জানিয়েছেন, আহত স্বামীকে হাসপাতালে নিয়ে আসার সময় পথে পথে ভোগান্তি ও হয়রানির কথা।

রবিবার (২৯ মে) ভোর ৫টায় বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলার শানুয়ার এলাকায় গাছের সঙ্গে বাসের ধাক্কায় ১০ যাত্রী নিহত হন। এ সময় আহত হন অন্তত ২০ জন। তাদের মধ্যে ছিলেন মরিয়মের স্বামী আনিসুর রহমান। তার বাড়ি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার ধাওয়ার রাজপাশা গ্রামে। পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকার নবীনগর থেকে যমুনা লাইন পরিবহনের বাসে ওঠেন তিনি। বসেছিলেন বাসের পেছনের আসনে।

মরিয়ম বেগম বলেন, ‘উজিরপুর উপজেলা থেকে ভান্ডারিয়ার ধাওয়ার রাজপাশা গ্রামের দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার। ভোররাতে স্বামীর দুর্ঘটনার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। তখন রাস্তায় কোনও যানবাহন পাচ্ছিলাম না। উপায় না পেয়ে ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটে আসি শানুয়ার এলাকায়।

 

এসে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন স্বামী। তাকে একাই উদ্ধার করে নিয়ে যাই উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে চিকিৎসা পাইনি। এরপর তাকে নিয়ে ছুটে আসি শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।’ তিনি বলেন, ‘শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করার পর ট্রলির প্রয়োজন হয়। ট্রলির জন্য টাকা দাবি করে সেখানকার কর্মচারীরা। টাকা না দেওয়ায় রোগীকে কোনোভাবেই ট্রলিতে উঠাতে দেয়নি তারা।

বাধ্য হয়ে তাদের ১০০ টাকা দিয়ে রোগীকে ট্রলিতে করে ওয়ার্ডে নিয়ে আসি।সেখানে আনার পর নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয়। এজন্য সব জায়গায় টাকা দিতে হয়েছে। টাকা ছাড়া সরকারি হাসপাতালে কোনও কাজই হয় না।এ নিয়ে কারও কাছে অভিযোগও দিতে পারছি না।স্বামীর চিকিৎসা করাবো, নাকি তাদের এসব হয়রানির অভিযোগ দেবো। অভিযোগ দিলে যদি আবার চিকিৎসা-ই বন্ধ করে দেয়। যাইহোক, টাকা-পয়সা দিয়ে হলেও স্বামীকে বাঁচাতে পারলাম, এটাই শুকরিয়া।’

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আনিসুর রহমান বলেন, ‘ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। সেখান থেকে বাড়ির জন্য ৪৮ হাজার টাকা নিয়ে শনিবার রাতে যমুনা লাইন বাসে উঠি। মানিকগঞ্জ অতিক্রমের আগে বাসের যন্ত্রাংশে সমস্যা দেখা দেয়। দুই ঘণ্টা পর আবার যাত্রীদের নিয়ে বাসটি রওনা হয়।

ওই দুই ঘণ্টা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য চালক একাধিক গাড়ি ওভারটেক করেছেন। দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ওই সময় মনে হয়েছিল, দুর্ঘটনা ঘটবে। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীরা ঘুমিয়ে পড়েন। আমিও ঘুমিয়ে ছিলাম। এরই মধ্যে ঘটে গেছে দুর্ঘটনা।’ তিনি বলেন, ‘ঘুমিয়ে থাকায় দুর্ঘটনার বিষয়টি টের পাইনি। মনে হচ্ছে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। জ্ঞান ফেরার পর আমার পাশে এক যাত্রীকে আহত অবস্থায় দেখতে পাই। তখন কান্নার শব্দ কানে আসে।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, বাসটি গাছের মধ্যে ঢুকে গেছে। তখন নামার জন্য বাসের দরজার দিকে আসি। এ সময় চেয়ে দেখি মানুষের খণ্ডিত হাত-পা পড়ে আছে। রক্ত আর রক্ত, লাশ আর লাশ। শরীরে রক্ত দেখে এক যাত্রী আমাকে পাশে টেনে বসান। তখন আমার খেয়াল হয় পকেটের টাকার কথা। হাত দিয়ে দেখি পকেটে কোনও টাকা নেই। হয়তো কেউ নিয়ে গেছে। পরে ফোন করে স্ত্রীকে দুর্ঘটনার কথা জানাই। খবর শুনে ৬০ কিলোমিটার দূর থেকে আমার স্ত্রী ছুটে এসেছে। অথচ ততক্ষণে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আসতে পারেননি। এজন্য গুরুতর আহতদের মৃত্যু হয়েছে।’

রূপাতলী বাস মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলামিন সিকদার বলেন, ৬০ কিলোমিটার দূর থেকে এসে যদি স্বজনদের আহতদের হাসপাতালে নিতে হয়, তাহলে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস দায়িত্বে কেমন অবহেলা করেছে তা পরিষ্কার বোঝা যায়। দুর্ঘটনার পর পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সময়মতো পাওয়া যায় না।

পুলিশ ও বাসযাত্রীরা জানিয়েছেন, যমুনা লাইন পরিবহনের বাসটি ঢাকা থেকে ভান্ডারিয়ায় যাচ্ছিল। শানুয়ার এলাকায় পৌঁছালে মেহগনি গাছের সঙ্গে ধাক্কায় বাসটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। বাসচালক ঘুমিয়ে পড়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চারতলায় চিকিৎসাধীন বাসের আহত যাত্রী সেলিম ও কালু জানান, তারা বাসের পেছনে বসেছিলেন। বাসটি যখন গাছে ধাক্কা দেয় তখন যাত্রীরা ঘুমিয়ে ছিলেন। গাছে ধাক্কা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব যাত্রী কমবেশি আহত ও নিহত হন। ওই সময় চালক ঘুমিয়ে ছিলেন। পরে বাসে ডাকাত ঢুকেছে বলে চালক পালিয়ে যান।

হাসপাতালে পদে পদে টাকা নেওয়ার বিষয়ে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এসএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘চিকিৎসাধীন রোগীদের হাসপাতালের ভেতরে বিনা টাকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য মাইকিং করা হয়েছে। এরপরও কেউ যদি এ ধরনের কাজ করে থাকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দুর্ঘটনায় আহত এমন রোগীদের কাছ থেকেও টাকা নেওয়ার বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।’

উজিরপুর মডেল থানার ওসি আর্শেদ আলী বলেন, ‌‘রবিবার বিকালে ১০ জন নিহতের ঘটনায় বাসচালককে অভিযুক্ত করে মামলা করেছেন পুলিশের সার্জেন্ট মাহাবুবুর রহমান। তবে চালকের নাম-পরিচয় এখনও জানা যায়নি। নাম-পরিচয় নিশ্চিত হতে এবং তাকে গ্রেফতারে পুলিশের একাধিক টিম অভিযান চালাচ্ছে। নিহত আট জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুই জনের লাশ শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আহতদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’