গত কয়েক দিন ধরে পুরো বরিশাল বিভাগে ছড়িয়ে পড়েছে ‘ছেলে ধরা’ আতঙ্ক। এই আতঙ্কে অনেক অভিভাবক নিরাপত্তার শঙ্কায় শিশু সন্তানদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ নিরাপত্তা বাড়িয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিয়ে আসছেন। কিন্তু বাস্তবে এখন পর্যন্ত কোনো ‘ছেলে ধরা’র সাথে কোনো ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েনি।
ঘটনাচক্রে বিভিন্ন স্থান থেকে ‘ছেলে ধরা’ সন্দেহে একাধিক ব্যক্তি বিশেষকে ধরে থানায় প্রেরণ করা হলেও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশ তাদের ছেড়ে দিচ্ছে। পুলিশ বলছে, যাদেরকে ‘ছেলে ধরা’ সন্দেহে তুলে দেওয়া হয় পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদে দেখা যায় তারা কেউ মানসিক রোগী বা কেউ ভিখারী।
গত কয়েকদিনে অন্তত ১০ জনের বেশি ব্যক্তিকে আটকে জিজ্ঞাসাবাদের এমন তথ্য পাওয়া যায়। পুলিশের দাবি বরিশালের কোথাও ‘ছেলে ধরা’র অস্তিত্ব নেই। কিন্তু বিষয়টিকে নিয়ে যেভাবে গুজব ছড়ানো হয়েছে তাতে শিশুদের অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি করায় অভিভাবকেরা বেশিমাত্রায় আতঙ্কিত।
সূত্রে জানা যায়, গত ১ সপ্তাহ ধরে বরিশালজুড়ে ‘ছেলে ধরা’ গুজব ছড়িয়ে পড়ে। গুজবের ধরণটা অনেকটা এমন অমুক জায়গা থেকে এক ছেলেকে ছেলেধরা নিয়ে গেছে। যাকে বলা হচ্ছে তিনি বলছেন, অমুক জায়গা থেকে ৩/৪ জনকে নিয়ে গেছে। এছাড়া মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েও একে অপরকে সতর্ক করছেন।
একটি মেসেজে দেখা যায়, ‘‘পদ্মাসেতুর জন্য মানুষের মাথার প্রয়োজন হচ্ছে, তাই ছোট ছোট বাচ্চাদের ধরে নিয়ে মাথা কেটে সেতুতে ব্যবহার করা হচ্ছে।’’ ইতোমধ্যে ছেলে ধরা সন্দেহে গুজব ছড়িয়ে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি কর্তৃক কয়েকজন মানসিক প্রতিবন্ধী ও ফকিরকে মারধর করার খবরও ফেসবুক মারফত জানা গেছে। তবে, এই প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এসব ছবি অনেক পুরানো এবং অন্য জায়গার ছবিকে বরিশালের বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর ছড়ালে স্থানীয় সাধারণ মানুষের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়ে।
অনেক অভিভাবক জানান, এলাকায় ‘ছেলে ধরা’ আসছে খবরে ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে। ছেলে ধরা আতঙ্কে বিদ্যালয়ের প্রতিটি ক্লাসে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি অর্ধেকের চেয়েও কমে গেছে। বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি কাজল ঘোষ বলছেন, ‘ছেলে ধরা’ নিয়ে অভিভাবক ও শিশুদের মাঝে যেভাবে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে তাতে তাদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। যার কারণে শিশুদের শিক্ষা-সংস্কৃতি কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ফলশ্রুতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও জাতি। অনতিবিলম্বে এটাকে প্রতিহত করা দরকার। কারণ আমার মনে হচ্ছে এটা একটি গুজব। পাশাপাশি প্রশাসনকে জরুরি ভিত্তিতে বিষয়টির সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করারও অনুরোধ জানান তিনি।
এ বিষয়ে বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম (পিপিএম) বলেন, ‘ছেলে ধরা’ খবরটি একটি নিছক গুজব। বরিশালের কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে- তার কোন সত্যতা নেই।
অতি উৎসাহী কিছু লোক কর্তৃক ‘ছেলে ধরা’ গুজবে কয়েকজন মানসিক প্রতিবন্ধী ও ফকিরকে মারধরের ঘটনা দু:খজনক। গুজবে কান না দিয়ে তিনি অভিভাবকদের আরো সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। সেই সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে গুজব না ছড়ানোর পরামর্শ দেন। বরিশাল নগরীর রুপাতলী ও গির্জামহল্লা এলাকার ঘটনা দুটির বিষয়ে তিনি বলেন, রুপাতলীতে যে লোকটিকে ‘ছেলে ধরা’ সন্দেহে স্থানীয়রা আটক করেছিলেন সে লোকটি ছিলো মানসিক প্রতিবন্ধী। আর গির্জা মহল্লা থেকে বাচ্চাসহ যে মহিলাটিকে আটক করা হয়েছিলো, সে বাচ্চাটা ছিলো ওই মহিলার বোনের মেয়ে।
একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, এটা স্রেফ গুজব। মানুষের অজ্ঞতাকে ভিত্তি করে এই গুজব ব্যাপক ডালপালা ছড়িয়েছে। কারা কোন্ উদ্দেশে এমন গুজব ছড়িয়েছে তা বোঝা মুশকিল। তবে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে সবাইকে গুজব সম্পর্কে সচেতন থাকতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে চরফ্যাশন থানার ওসি সামসুল আরেফিন জানান, সাধারণ মানুষ থানায় ফোন দিয়ে ছেলে ধরার বিষয়টি জানতে চায়। মোবাইল থেকে মোবাইলে মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠিয়ে গুজবটি ব্যাপকভাবে ছড়ানো হয়েছে। এ গুজব ছড়ানোর নেপথ্যে কারা তাদের খুঁজে বের করতে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে নামবে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মো. ছালেহ্ উদ্দিন বলেন, ‘ছেলে ধরা’ খবরটি নিছক গুজব। এমন গুজব ছাড়ানোর কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছিনা। তারপরেও পুলিশ প্রশাসন বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে দেখছে।