বরিশালে নদী ভাঙনরোধে ৯ প্রকল্প, বাস্তবায়ন নেই ছিটেফোঁটাও

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হঠাৎ কীর্ত্তনখোলা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যায় বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা। ওই সময় ১১ জনের মৃত্যু হয়। এর পরপরই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে স্থায়ীভাবে নদীভাঙন রোধের প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁদের প্রতিশ্রুতি অনুসারে ওই বছরের মাঝামাঝি নদীভাঙনের হাত থেকে চরবাড়িয়া ইউনিয়নের সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা রক্ষায় ৪.৫১০ কিলোমিটার তীর রক্ষাবাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠায় পানি উন্নয়ন বোর্ড। এর ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩৩১ কোটি ২৩ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। এরপর ওই প্রকল্প ফাইল চাপা পড়ে থাকে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ফের কীর্ত্তনখোলার ভাঙনে ওই এলাকার বিভিন্ন স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়, মারা যায় সাতজন। ফের টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। ফলে সেই ফাইলটি ওই বছরই পরিকল্পনা কমিশনে প্রাক-একনেক সভায় একনেকের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু এরপর আবার গত দুই বছর ধরে তা আটকে রয়েছে একনেকের অনুমোদনের জন্য। আর এরই মধ্যে কীর্ত্তনখোলার ভাঙনে নিঃস্ব হয়েছে ওই এলাকার বহু মানুষ।

অন্যদিকে কীর্ত্তনখোলার নদীর অন্য পাড়ে চরকাউয়া এলাকায় ভাঙনরোধে এক কিলোমিটার জায়গাজুড়ে ব্লক বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে পাউবো কর্তৃপক্ষ। ৪৫ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি বোর্ডের অনুমতি পেলে তা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু প্রি-একনেক কিংবা একনেক তো দূরের কথা গত প্রায় দেড় বছরেও মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটির অনুমোদন মেলেনি। এরই মধ্যে নদীর অব্যাহত ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে চরকাউয়া এলাকার বহু স্থাপনা।

কেবল কীর্ত্তনখোলা নদীর ভাঙনই নয়, বরিশালে এ রকম আরো পাঁচটি নদীর ভাঙন থেকে এলাকাবাসীকে রক্ষায় গত সাত বছরে বড় ধরনের ৯টি নদীশাসন প্রকল্প গ্রহণ করেছে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ; যার একটিও আলোর মুখ দেখেনি। ফলে ভাঙনকবলিত মানুষগুলো দিন কাটাচ্ছে নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে। দিন দিন ভাঙনের তীব্রতা ও ভাঙনকবলিত এলাকার আকার বেড়েই চলেছে। ইতিমধ্যে বরিশালের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে বহু গ্রাম ও স্থাপনা। আর মৃত্যু হচ্ছে অসংখ্য মানুষের।

সুগন্ধা নদীর অব্যাহত ভাঙনে বাবুগঞ্জ উপজেলার অর্ধেকের মতো নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। এই নদীর ভাঙনরোধে নেওয়া দুটি প্রকল্পের তেমন অগ্রগতি নেই। সুগন্ধার ভাঙন থেকে রহমতপুর এলাকার বিমানবন্দর ও আবুল কালাম ডিগ্রি কলেজ, তত্সংলগ্ন আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙন থেকে মুলাদীর মীরগঞ্জ ফেরিঘাট, মীরগঞ্জ বাজারসহ মূল্যবান এলাকা রক্ষায় সাড়ে চার বছর আগে প্রকল্প গ্রহণ করে পাউবো কর্তৃপক্ষ। চার কিলোমিটারজুড়ে নদীশাসন ও বাঁধ প্রকল্পে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩৬৪ কোটি ৯২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। কিন্তু সাড়ে চার বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে শুধু বোর্ডের যাচাই-বাছাই কমিটির প্রকল্পটি গ্রহণ করে তা পুনর্গঠন কাজের জন্য নির্দেশ দেওয়া পর্যন্ত।

মেঘনা নদীর ভাঙন থেকে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া-গবিন্দপুর রক্ষায় দুই কিলোমিটার স্থায়ী ব্লক বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পও ঝুলে আছে। প্রায় দুই বছর আগে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাই সভা হয়েছে ৩৯৫ কোটি ৯৪ লাখ ৩২ হাজার টাকার এই প্রকল্পটি নিয়ে। একই অবস্থানে রয়েছে কয়লা নদী (খাল) ভাঙন থেকে মুলাদীর বাহাদুরপুর গ্রাম ভাঙন রোধ প্রকল্প। উপজেলার কাজীরচর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের ভাঙন রোধে ৩.২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণে ৯৯ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে তিন বছর আগে বোর্ডের অনুমতির জন্য পাঠানো হয়েছিল। এই প্রকল্পটিও শুধু পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাই সভা হয়েছে।

এর ছয় বছর আগে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের বাবুগঞ্জে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (দোয়ারিকা) সেতুর বরিশাল প্রান্ত রক্ষায় শূন্য দশমিক ৭৬০ কিলোমিটার বাঁধ এবং তত্সংলগ্ন নদীতে ড্রেজিং প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সড়ক ও জনপদের পক্ষে ১১ কোটি ১৫ লাখ টাকার এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্টাডি, ডিজাইনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখানে ব্লক বাঁধ ছাড়াও ৪৭ হাজার জিও ব্যাগ ফেলার কথা ছিল সওজ কর্তৃপক্ষের। কিন্তু আদৌ তা হয়নি। তবে এই প্রকল্পের অগ্রগতির অংশ হিসেবে সওজের পক্ষে ডিপোজিট ওয়ার্ড হিসেবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করে প্রকল্পটি সওজ অধিদপ্তরে প্রেরণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

সন্ধ্যা নদীর ভাঙন থেকে বাবুগঞ্জ উপজেলার দেহরগতি ইউনিয়নের উত্তর বাহেরচর বাজার ও তত্সংলগ্ন এলাকা রক্ষায় ১৩ কোটি ৬২ লাখ ৮৩ হাজার টাকা ব্যয়সাপেক্ষে এক কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যা বোর্ডের সভা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন শেষে পাঠানো হয়েছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় মেঘনা নদীর ভাঙন থেকে হিজলা উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়ন কমপ্লেক্স, বাজার, লঞ্চঘাট ও তত্সংলগ্ন এলাকা রক্ষায় দ্বিতীয় পর্যায়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ৯ কোটি ৮৮ লাখ ৭২ হাজার টাকা ব্যয়সাপেক্ষে শূন্য দশমিক ৫৬০ কিলোমিটার নদীর তীর রক্ষাবাঁধ প্রকল্পটি বোর্ডেই আটকে আছে। বোর্ডের যাচাই-বাছাই কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী প্রকল্প পুনর্গঠন কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাব মাকাবেলায় জয়ন্তী নদীর ভাঙন থেকে মুলাদী উপজেলাধীন নাজিরপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ নাজিরপুর থেকে ঘোষের চর খেয়াঘাট পর্যন্ত শূন্য দশমিক ৬০০ কিলোমিটার এলাকা রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পটিও বোর্ডের যাচাই-বাচাই কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী প্রকল্প পুনর্গঠনপূর্বক পকল্প প্রস্তাবনা বোর্ডে দাখিল করা হয়েছে। কিন্তু ওই প্রস্তাবনা এখনো বোর্ডের যাচাই-বাছাই কমিটিতে উত্থাপন হয়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ জানান, অন্যান্য দপ্তর থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রম অনেকটাই পৃথক। একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়। বোর্ড, মন্ত্রণালয়, প্রি-একনেক এবং একনেকের অনুমোদন শেষে দরপত্র এবং সব শেষে কার্যাদেশ। এসব প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে সেখানে আপৎকালীন প্রটেকশন ছাড়া স্থানীয়ভাবে কোনো কাজ এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। প্রকল্পগুলো অনুমোদন হয়ে এলে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করা হবে।’ তবে তাতে কত সময় প্রয়োজন হবে সে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তা।

বরিশাল সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘আমরা নদীভাঙনের হাত থেকে এলাকাবাসীকে রক্ষা করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে স্থায়ীভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলেছি। তারা বলেছে, প্রকল্প হাতে নিয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এর কোনো বাস্তবায়ন নেই।’

বরিশাল-২  আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় আমরা পানিসম্পদ মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন সরেজমিনে এসে বরিশালের নদীগুলোর ভাঙন পরিদর্শন করবেন। এরপর যেসব প্রকল্প বরিশালের নদীভাঙনরোধে নেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন করা হবে।’