ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বিপন্ন মানুষের যখন সবচেয়ে বেশি দরকার মোবাইল ফোনের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ, ঠিক সে সময়েই মোবাইলের নেটওয়ার্ক থাকে না দুর্গত এলাকায়। ২০০৭ সালে আঘাত হানা সুপার সাইক্লোন সিডর থেকে সোমবারের সিত্রাং পর্যন্ত টানা ১৫ বছর এমনই অভিজ্ঞতা দেশের উপকূলীয় এলাকার কয়েক কোটি মানুষের।
নেটওয়ার্কের টাওয়ারগুলোতে জেনারেটরের পরিবর্তে ব্যাটারি ব্যবহার ও টাওয়ার দেখাশোনার জন্য দক্ষ লোক না থাকার কারণেই সৃষ্টি হচ্ছে এ পরিস্থিতি। এমনও দেখা গেছে, স্থানীয় কিছু লোককে শুধু টাওয়ার পাহারা দেওয়ার জন্য রাখা ছাড়া আর কোনো দায়িত্বই পালন করে না মোবাইল অপারেটরগুলো। বড় ধরনের কোনো সমস্যা দেখা দিলে খবর পাওয়ার ২-৩ দিন পর গিয়ে তা সমাধান করে সংশ্লিষ্টরা।
মূলত খরচ বাঁচাতেই এটা করে মোবাইল কোম্পানিগুলোর মালিকরা। ফলে নেটওয়ার্ক বন্ধ কিংবা অন্য যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে কারও কাছেই কিছু বলার সুযোগ থাকে না গ্রাহকদের।
দেশের দক্ষিণ উপকূলে সোমবার রাত ১০টা নাগাদ আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। এর প্রায় ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা আগেই দেখা দেয় মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যা। পটুয়াখালীর সমুদ্র তীরবর্তী উপজেলা রাঙ্গাবালীর সঙ্গে মোবাইলের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় বিকাল ৪টা থেকে। প্রায় সব অপারেটরের মোবাইল ফোনেই দেখা দেয় সমস্যা। একই ঘটনা ঘটে সাগরপাড়ের কলাপাড়া, পাথরঘাটা, কলাগাছিয়া, চরমোন্তাজসহ প্রায় সব এলাকায়। মাঝেমধ্যে নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলেও ফোনে পেতে ৮ থেকে ১০ বার পর্যন্ত চেষ্টা করতে হয় গ্রাহককে।
সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটার বাসিন্দা নাসিরউদ্দিন বলেন, বিকাল ৪টার পর গ্রামীণ ফোনে কোনো কল করা যাচ্ছিল না। কেউ কল করেও পাচ্ছিল না। এদিকে সিত্রাংয়ে আতঙ্কিত ছিলাম সবাই। দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা আত্মীয় পরিজনরাও চেষ্টা করছিলেন ফোনে যোগাযোগের। কিন্তু কারও সঙ্গেই কোনো যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। এ এক ভয়ংকর অনুভূতি।
যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মোবাইল নেটওয়ার্কের এ দুরবস্থার বিষয়ে খোঁজ নিতে মেলে ভেতরের চাঞ্চল্যকর তথ্য। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে থাকা মোবাইল টাওয়ারগুলোর অধিকাংশই চলে বিদ্যুতে। অবশ্য বিদ্যুৎ না থাকলে কয়েক ঘণ্টা চলার মতো ব্যাটারি সাপোর্ট থাকে এসব টাওয়ারে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে ৩-৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকলেই বন্ধ হয়ে যায় টাওয়ারের কার্যক্রম। সেই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মোবাইল নেটওয়ার্ক। বরগুনার পাথরঘাটার ইমাম হোসেন বলেন, শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগেই হয় নয়, যে কোনো সময় ৪-৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকলেই বন্ধ হয়ে যায় মোবাইলের যোগাযোগ। এ সমস্যায় আমরা নিত্যদিন ভুগি।
এ অভিযোগের সত্যতা মেলে মোবাইল অপারেটরগুলোর নেটওয়ার্কিং টাওয়ারের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বক্তব্যে। বরগুনা বেতাগীর গ্রামীণফোন নেটওয়ার্কের ইনচার্জ মাইনুল ইসলাম জানান, এখানে থাকা নেটওয়ার্ক টাওয়ারে কোনো জেনারেটর নেই। ব্যাটারির যে ব্যাকআপ রয়েছে তাতে ২ ঘণ্টা টাওয়ার চালু থাকে। তারপর বন্ধ হয়ে যায়।
কুয়াকাটার মোহাম্মদ উল্লাহ সড়কে রয়েছে দেশের সব মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্কিং টাওয়ার। সেখানে বাংলালিংক টাওয়ারের দায়িত্বে থাকা নেছার আহম্মেদ বলেন, ব্যাটারি ব্যাকআপ আছে ৩ ঘণ্টার। তবে একইসঙ্গে এ টাওয়ারে জেনারেটরও রয়েছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেনারেটর চালু হয়ে ব্যাটারি চার্জ করে। তবে সোমবার ঝড়ের দিন যে কেন নেটওয়ার্ক ঝামেলা করেছে সে ব্যাপারে আমি বলতে পারব না। এটা বলতে পারবেন নেটওয়ার্ক প্রকৌশলীরা।
উপকূলীয় জেলা বরগুনা ও পটুয়াখালীতে গ্রামীণফোনের টাওয়ার দেখভালের দায়িত্বে থাকা ডালি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক বিভাষ চন্দ্র গোমস্তা বলেন, এ দুই জেলায় আমাদের ৪শর বেশি টাওয়ারের মধ্যে ৮৫-৮৬টিতে জেনারেটর রয়েছে। এছাড়া বর্তমান দুর্যোগে আরও ৬৫টি টাওয়ারে ছোট জেনারেটর দিয়ে ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। বাকি টাওয়ারগুলো চলে ব্যাটারি ব্যাকআপে। তবে যেভাবে নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা বলা হচ্ছে তা ঠিক নয়। পুরো সময় ধরেই নেটওয়ার্ক রয়েছে।
গ্রামীণফোনের পাশাপাশি এ অঞ্চলে থাকা অন্যান্য মোবাইল অপারেটরের ক্ষেত্রেও মিলেছে প্রায় একই তথ্য। তাছাড়া অনেক টাওয়ারে রয়েছে সব অপারেটরের নেটওয়ার্কিং। ফলে জটিলতা দেখা দিলে সবগুলোতেই দেখা দেয়।
বরিশাল নাগরিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, মোবাইল ফোনের গ্রাহকরা সবাই প্রি-পেইড সিস্টেমের। অথচ আমাদের সঙ্গে অপারেটরগুলো যা করছে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এখন দেশে জ্বালানি সংকট চলছে। শহরে না হলেও গ্রাম এলাকায় ৪-৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকা একেবারেই স্বাভাবিক। দেখা যায়, বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার ২-৩ ঘণ্টা পার হলেই মোবাইল নেটওয়ার্কে সমস্যা শুরু হয়। সিত্রাংয়ের দিন শুধু উপকূল নয়, বরিশাল নগরেও মোবাইল নেটওয়ার্ক ঝামেলা করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকলেই যদি মোবাইলের টাওয়ার বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকার? মোবাইল কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে শতকোটি টাকা আয় করছে। অথচ আমাদের তারা মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, মোবাইল অপারেটরগুলোকে বলা হোক সব টাওয়ারে সার্বক্ষণিক স্বয়ংক্রিয় জেনারেটর দিতে। তাহলে ভবিষ্যতে আর এ রকম সমস্যায় পড়বে না কেউ। সূত্র:যুগান্তর
© স্বত্ব আর্থটাইমস্ ২৪.কম
প্রকাশক ও সম্পাদক: মোঃ জাকারিয়া আলম (দিপু)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ:বরিশাল-৮২০০।
আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:::
নিউজ মেইল:::
earthtimes24@gmail.com(নিউজ)
news@earthtimes24.com(নিউজ)
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
২০১৭ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত earthtimes24.com