বরিশালে আসামীর পক্ষ হয়ে পিপির বিরুদ্ধে বাদীর জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেয়ার অভিযোগ

লেখক:
প্রকাশ: ১ সপ্তাহ আগে

রবিউল ইসলাম রবি, বরিশাল ॥ দাবিকৃত চাঁদার টাকা না পেয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে জখম করার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলার আসামিদের পক্ষ হয়ে বাদীর জোরপূর্বক ওকালতনামা সহ চারটি নীলা কাগজে স্বাক্ষর নেয়ার অভিযোগ উঠেছে বরিশাল জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবুল কালাম আজাদ এর বিরুদ্ধে। বুধ ও বৃহস্পতিবার (১২ ও ১৩ মার্চ) দুপুরে বরিশাল জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ওই পিপির অফিস কক্ষে আসামিদের আত্মীয় ও সাঙ্গপাঙ্গদের সহযোগিতায় এ ঘটনা ঘটে। এ তথ্যের স্বীকার করেন প্রায় এক ডজন সাংবাদিকদের কাছে ভিডিও বক্তব্য দেন দায়েরকৃত মামলার বাদী বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য এ্যাড. ফরিদ আহম্মেদের সহকারী মো. আসাদুল আহসান হাং আসলাম।

ভিডিও বক্তব্যে আসলাম বলেন, আমি ভিকটিম মো. শেখ সাদীর ফুফাতো ভাই। সে একজন ইট বালু ব্যবসায়ী। তার কাছে তিন লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে তাকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে জখম করার ঘটনায় চলতি বছরের ১০ ফ্রেব্রুয়ারী বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানায় আমি বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করি। বুধবার (১২ মার্চ) অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ওই মামলার ৮ জন আসামি উপস্থিত হয়ে জামিনের আবেদন করলে বিচারক মোঃ হাবিবুর রহমান চৌধুরী ৩ জনকে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন এবং বাকি ৫ জনের জামিন মঞ্জুর করেন। এইদিনই আদালত চত্বর থেকে আমাকে মিজান মুহুরি, সোহাগ গাজী, ইউসুব বক্তিয়ার সহ আসামি সরোয়ার, রিয়াজ নামে দুই জন, তানজিল, মাহাবুব ও হারিচ জোরপূর্বক পিপির রুমে নিয়ে কিল ঘুসি দিয়ে ওকালতনামা সহ চারটি নীলা কাগজে স্বাক্ষর নেয়।

পিপি আবুল কালাম আজাদ বলেন, মামলাটি মীমাংসার জন্য আমার কাছে বাদী ও আসামীরা এসেছিলেন। আসামিদের জামিনে আপত্তি নেই এই মর্মে দায়েরকৃত মামলার বাদী আসলাম নিজ ইচ্ছায় স্বাক্ষর দিয়েছেন। তার কাছ থেকে জোর করে স্বাক্ষর নেয়া হয়নি। পিপি আবুল কালাম আজাদের সাক্ষাৎকার নেয়ার পরই দায়েরকৃত মামলার বাদী আসলাম প্রতিবেদকের মুঠোফোনে কল করে জানান, এই সংবাদ প্রকাশ হলে আমি আর বরিশাল থাকতে পারবো না। আপনি (প্রতিবেদক) পিপি স্যারকে কল বলেন আসলামের সাথে কথা হয়েছে। কোনো সমস্যা নেই। এ ঘটনার মধ্যে এখন রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করেছে।

বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাড সাদিকুর রহমান (লিংকন) বলেন, একজন পিপি এমন কাজ করতে পারে বলে বিশ্বাস হয় না।

বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. মির্জা রিয়াজ বলেন, রাষ্ট্র পক্ষের নিযুক্ত কোন পিপির আসামির পক্ষ নেয়ার সুযোগ নেই। পিপিদের বাদীর পক্ষে কাজ করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। যদি বাদীর কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে রাষ্ট্র পক্ষের কেউ খালি কাগজে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেয় সেটা আইনবহির্ভূত।

মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০২৫ সালের ২ ফ্রেব্রুয়ারী রাত সাড়ে নয়টায় নগরীর ২৬ নং ওয়ার্ড ‘ হরিনাফুলিয়া এমদাদিয়া মাদ্রাসা ‘ এর পশ্চিম পার্শ্বে মামলার সাক্ষীরা ড্রেজারের পাইপ সংযোগ করছিল। তখন আসামীরা হাতে অস্ত্র নিয়ে ঘটনাস্থলে বালু ফেলে ব্যবসা করতে হলে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। সাক্ষীরা প্রতিবাদ করলে আসামীরা তাদের মারধর করে ৫/৭টি পাইপ ভেঙ্গে ২০ ফুট লম্বা ৬ ইঞ্চির ২০টি পাইপ নিয়ে যায়। পরের দিন অর্থাৎ ৩ ফ্রেব্রুয়ারী রাতে মামলার ৩ নং সাক্ষীকে নামিয়ে ১ নং সাক্ষী মো. শেখ সাদী ‘ বরিশাল-ঝালকাঠি মহাসড়কের রুপাতলী জাগুয়া কলেজের উত্তর পার্শ্বে গ্যাসের গোডাউন গেটের সামনে’ যাবার সময় আসামীরা তাকে এলোাপাথারীভাবে ২ হাত ২ পা কুপিয়ে জখম করে। ঘটনার পর আহতকে শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি করলেও কর্মরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা প্রেরণ করেন। ১ মাস ৭ দিন ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।

অসুস্থ শেখ সাদী বলেন, আমি জীবনে স্বাভাবিকভাবে হাত-পা আর ব্যবহার করতে পারবো না বলে মনে হয়। আমাকে আসামীরা মৃত্যু নিশ্চিত করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছিল। এখন পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে বেচে আছি। কিন্তু অপরাধীদের বিরুদ্ধে ন্যায্য বিচার পাওয়ার জন্য আমি বর্তমান সরকার, বাংলাদেশ সেনা বাহিনী সহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের সুদৃষ্টি কামন করছি। আমার পাশে কেউ নেই। আমি কারো কাছে যেতে পারি না, কারণ হাঁটতে পারি না।

আসামীরা হলেন- ১। মো. হুমায়ুন কবির রিপন ওরফে ফেন্সি রিপন, পিতা মজিবর রহমান হাওলাদার, সাং-হরিনাফুলিয়া ২। জিয়াউর রহমান (৪২), পিতা মৃত আবদুল সত্তার হাওলাদার, ৩। মো. সাইদুল (৩২), পিতা. আঃ খালেক হাওলাদার, ৪। মিথুন খান (৩০), পিতা মৃত মান্নানখান, সর্ব সাং জাগুয়া, ৫। মো. রাজীব (৩০), পিতা. আ. লতিফ, ৬। মনজু (৪২), পিতা মৃত এফাজ উদ্দিন, ৭। মো. রাকির গাজী (২১), পিতা. সুলতান গাজী, সাকিন- রায়পুরা, থানা- নলছিটি, জেলা ঝালকাঠি, হাল সাং-জাগুয়া, ৮। তোতা খাঁন(৪১), পিতা মৃত আঃ মজিদ খান, ৯। মো. রিয়াজ (৪৩), পিতা-মৃত ইউনুচ হাওলাদার, ১০। হারিচ হাওলাদার (৩৬), পিতা মৃত মোক্তার আলী, ১১। মো. ছালাম মোল্লা (২৫), পিতা মন্টু মোল্লা, ১২। মো. সরোয়ার (৩৮), পিতা মৃত আঃ আউয়াল, ১৩। মো. মাহাবুব (৩৫), পিতা আনিচ হাওলাদার, ১৪। মো. তানজিল(২২), পিতা দেলোয়ার হাওলাদার, ১৫। মো. রিয়াজ (২৮), পিতা আ. রহিম, সর্ব-সাকিন : হরিণাফুলিয়া থানা- কোতয়ালী, জেলা বরিশাল সহ অজ্ঞাতনামা ২০/৩০ জন।

জানা গেছে, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতয়ালী থানার এসআই মো. সাইফুল ইসলাম এখন পর্যন্ত আদালতে চার্জশীর্ট প্রেরণ করেননি এবং আসমীরা প্রকাশ্যে ঘুরলেও কাউকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়নি। তাই মামলাটি আদালত থেকে বেস্তে পাঠানোর পরিকল্পনা চলছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে একাধিকবার কল দিলেও ধরেননি।

একাধিক আইজীবী বলেছেন, রাষ্ট্র পক্ষের একজন আইনজীবী কোনক্রমেই আসামীর পক্ষে অবস্থান নিতে পারে না। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিৎ। কারণ, আদালতে মানুষ আসে ন্যায্য বিচার চাইতে। সেখানে রাষ্ট্র বাদীর পক্ষ থাকার জন্য আইনজীবী নিয়োগ দেয়। সেখানে সেই আইনজীবী আসামীর পক্ষ নিয়েছে বলে সমালোচনার ঝড় বইছে। বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন অনেকেই।