বরিশালের বানারীপাড়ার দুইশ বছরের ঐতিহ্য এখন ধূসর অতীত ধান-চালের ব্যবসা

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

প্রায় দুইশ বছর আগে ব্রিটিশ শাসনামলে বরিশালের বানারীপাড়ায় ধান-চালের ব্যবসার গোড়াপত্তন হয়। কালক্রমে এর বিস্তৃতি ঘটে। বরিশালের বালাম চালের সুনাম দেশের সর্বত্র এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও।

বালাম চাল বানারীপাড়ায়ই প্রক্রিয়াজাতকরণ হয়। বালাম ছাড়াও অন্যান্য চালের চাহিদা ও সুনামের জন্য ঢাকা, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, ফরিদপুর, পটুয়াখালী, সন্দ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকার শত শত ফরিয়া এখানে এসে চাল ক্রয় কিনে নিয়ে যেতেন।

সিলেট, ভৈরব, আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, পটুয়াখালী, সন্দ্বীপ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, ভোলা, ঝিনাইদহ, যশোর প্রভৃতি স্থনের ব্যবসায়ীরা তাদের এলাকায় উৎপন্ন ধানের প্রচুর চাহিদার কারণে ধান বিক্রি করতে বানারীবাড়ায় আসতেন।

এখন আর সেই জৌলুস নেই। নেই বানারীপাড়ার সুনাম ও সুখ্যাতি। হাটবাজারের পরিধি সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। দূরদূরান্তের ব্যবসায়ী, কৃষক ও কুঠিয়ালরা ক্রমেই মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে নানা কারণে।

তথ্যসূত্রে জানা গেছে, ধান-চালের ব্যবসার ওপর বানারীপাড়ার অন্যান্য ব্যবসা নির্ভরশীল ছিল। নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত পাঁচ সহস্রাধিক পরিবার কুঠিয়ালী (চাল উৎপাদনকারী) পেশার ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

এ উপজেলায় ৭০ ভাগ মানুষ একসময় এ ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। কুঠিয়ালদের সংখ্যা একসময় ছিল প্রায় ২৫ হাজার। উপজেলায় শতাধিক রাইস মিল ছিল। সন্ধ্যা নদীতে নৌকায় ভাসমান হাটে মূলত ধান-চাল বিক্রি হয়।

একসময় বানারীপাড়া বন্দর বাজার, পশ্চিমপাড় দাণ্ডয়াট থেকে শুরু করে রায়েরহাট পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটারজুড়ে সন্ধ্যা নদী ও এর শাখা নদী-খালে ভাসমান অবস্থায় হাজার হাজার নৌকায় ধান চালের হাট বসত। বর্তমানে বানারীপাড়ার লঞ্চঘাট সংলগ্ন সন্ধ্যা নদীতে ভাসমান চালের হাটটি এবং নদীর পশ্চিমপাড় দাণ্ডহাটে ভাসমান ধানের হাটটি বসে।

রবি ও বুধবারের হাটকে বলা হয় গালার হাট। উপজেলার নলশ্রী, দিদিহার, দাণ্ডয়াট, বাইশারী, মসজিদবাড়ী, আউয়ার, কালিরবাজার, খোদাবখশ, মলঙ্গা, চাখার, বাকপুর, জিরারকাঠী, ভৈৎসর, চালিতাবাড়ী, চাউলাকাঠী, কাজলাহার, ব্রাহ্মণকাঠী, জম্বদীপ, নাজিরপুরসহ আশপাশের এলাকায় শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি মানুষ এ কাজে জড়িত ছিল।

হাট থেকে ধান কিনে বাড়িতে নিয়ে নারী-পুরুষ সবার সম্মিলিত শ্রমে তা প্রক্রিয়াজাত করে চাল তৈরি করে পরবর্তী সেই ভাসমান হাটে বিক্রি করা হতো। একসময় তাদের স্থানীয় মহাজনদের হাতে শোষিত ও বঞ্চিত হতে হয়েছে।

১৯৮৯-৯০ সালে এ নিয়ে মহাজনদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। যার প্রভাব পড়ে ধানচালের হাটে। মহাজনদের সঙ্গে কুঠিয়ালদের দীর্ঘস্থায়ী বিরোধে সাধারণ ব্যবসায়ীরা মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বিভিন্ন জেলা-উপজেলা সদরে হাটবাজার গড়ে ওঠে। ফলে গত দেড় দশকে কুঠিয়াল পরিবারের সংখ্যা ৫ হাজার থেকে কমে এক হাজারে নেমে আসে।

এ অবস্থায় ১৫-১৬ বছর ধরে বানারীপাড়ায় ধানচালের ব্যবসা ক্রমশ খারাপের দিকে চলে যায়। বেশির ভাগ কুঠিয়াল তাদের মূলধন খুইয়ে ফেলেছেন। অনেকে নৌকা বিক্রি করে দিয়েছেন।

আড়তদাররা তাদের ঐতিহ্যবাহী এ ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। বানারীপাড়ার আড়তদার পট্টির বহুঘর এখন ভাড়াটিয়াবিহীন অবস্থায় পড়ে আছে। এ ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হাজারো পরিবার এখন অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছে।

বানারীপাড়ার সুপ্রাচীন এ ব্যবসা বন্ধ হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানা যায়, যেসব স্থান থেকে অতীতে ব্যবসায়ীরা আসতেন ধানচাল কেনা-বেচার জন্য, সেসব স্থানে মোকাম গড়ে উঠেছে এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে চাল উৎপাদন হওয়ায় খরচ অনেক কম হয়।

সে কারণেই ব্যবসায়ীরা দলে দলে এখন আর বানারীপাড়ায় আসছেন না। এ ছাড়া দূর অঞ্চল থেকে চাল বহন খরচ, কমিশন, নীরব চাঁদাবাজি, অতিরিক্ত টোল আদায়, অসাধু ব্যবসায়ীদের জালিয়াতি ইত্যাদি কারণে ব্যবসায়ীরা বানারীপাাড়ায় আসছেন না বলে জানা গেছে।