দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত মানুষ প্রতিনিয়ত জ্ঞান অর্জন করে। এই জ্ঞান সঞ্চয়ের কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। তাই ভবিষ্যত প্রজন্মকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে ‘আমরা করব জয়’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে বরিশালের উজিরপুরে গড়ে উঠেছে “জ্ঞানের পাঠশালা” নামে একটি অ-রাজনৈতিক সংগঠন।
মাত্র এক বছর পূর্বে ২০১৮ সালের ১১মে উপজেলার গুঠিয়া মডেল ইউনিয়নের ডহরপাড়া গ্রামে ‘জ্ঞানের পাঠশালা’ যাত্রা শুরু করে। এখানে স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণীর জ্ঞান পিপাসু ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হয়ে সাধারণ জ্ঞান অর্জন করছেন। শুধু সাধারন জ্ঞানই নয় এখানে শিক্ষার্থীদের ইংরেজী ভাষা শিক্ষা, বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষা, বিতর্ক শিখন-প্রতিযোগীতা, কুইজ প্রতিযোগীতা, ভাইভা পরীক্ষার প্রস্তুতি, সৃজনশীলতা বৃদ্ধির কৌশল, সংগীত চর্চা, ধর্মীয় শিক্ষা, প্রাথমিক চিকিৎসার ধারনা, বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প শিখন ও সমাজসেবা মূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।
বর্তমানে ‘জ্ঞানের পাঠশালা’ সংগঠনটির শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় দেড় শতাধিক। মাত্র ১০ টাকা দিয়ে একবার ভর্তি হয়ে বিনা বেতনে প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার ক্লাস করছেন এসব শিক্ষার্থীরা। প্রতি সপ্তাহে এখানে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন শিক্ষার্থী। ইতোমধ্যে জ্ঞানের পাঠশালা ও তার পরিচালনাকারীরা এলাকার সর্বস্তরের মানুষের সাধুবাদ অর্জন করেছেন। তবে সংগঠনটির রয়েছে কিছু প্রতিবন্ধকতা। বসার ব্যবস্থা এবং শিক্ষা উপকরণসহ তাদের রয়েছে নানা সংকট। পরিচালনার সঙ্গে যুক্তরা নিজেরাই ছাত্র হওয়ায় নিজেদের টাকায় এর জন্য বেশি উপকরণ কিনে দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাদের একটি পাঠাগারও আছে।
যেখানে জ্ঞানের পাঠশালা পরিচালনাকারী শিক্ষার্থীদের নিজেদের টাকায় ক্রয়কৃত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনসহ শতাধিক প্রকারের বই রয়েছে। বাঁশ দিয়ে সেলফ তৈরি করে বইগুলো সাঁজিয়ে সকলের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে পাঠাগারটি। তাছাড়া নিজস্ব কোনো ভবন কিংবা ক্লাসরুম না থাকায় স্থানীয় সামাদিয়া দারুল উলুম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণী কক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান দেওয়া হয়। এতে মাঝে মধ্যে শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়।
সূত্রে জানা গেছে, জ্ঞানের পাঠশালা সংগঠনটির প্রধান উদ্যোক্তা উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের ডহরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও বরিশাল সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র মো: আরিফ মোল্লা। তবে এটির সার্বিক পরিচালনায় রয়েছেন একই গ্রামের বাসিন্দা এবং বরিশাল সরকারি শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষা ব্যাচেলর (বিএড) বিভাগের অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্রী রাইসা রহমান উর্মি। এই দুই শিক্ষার্থীর অদম্য উদ্যোগেই বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া গুঠিয়া ইউনিয়নের একদল উদ্যমী শিক্ষার্থীদের সহযোগীতায় এই জ্ঞানের পাঠশালা নামের সংগঠনটি পথচলা শুরু করে।
সেচ্ছাসেবী সংগঠনটির সভাপতি রাইসা রহমান উর্মি জানান, উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য সে নিজে রাজধানীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখিন হয়ে তিনি সেখানে ভর্তি হতে পারেননি। এর কারন ছিলো একাডেমিক শিক্ষার বাইরে সাধারন জ্ঞান সম্পর্কে তার কোনো ধারনা না থাকা। একই কথা জানিয়েছেন সংগঠনটির উদ্যোক্তা মোঃ আরিফ মোল্লা ।
তিনি জানান, সাধারণ জ্ঞান সম্পর্কে তারা অজ্ঞ হওয়ায় সমস্যার সম্মুখিন হয়েছেন। তাই ভবিষ্যত প্রজন্মকে জ্ঞানসম্পন্ন করে তোলার লক্ষ্যে তারা ‘জ্ঞানের পাঠশালা’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এরপরই তাদের উদ্যোগের সাথে একত্বতা প্রকাশ করে এগিয়ে আসেন একই ইউনিয়নের আরও ৯ জন কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী।
তারা হলেন আফরিন জাহান স্বর্না, ফয়সাল রাব্বি, মো: মঈন খান, মো: শামিম হাওলাদার, মোঃ বনি আমিন, মোঃ নাসিম খান, মোঃ রাহাত মিঞা। এরা সকলেই উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের ডহরপাড়া গ্রামের সামাদিয়া দারুল উলুম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তারা প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছেন যেন আর কোনো শিক্ষার্থী সাধারন জ্ঞানের অভাবে পিছিয়ে না পড়ে।
জ্ঞানের পাঠশালা সংগঠনের সাধারন সম্পাদক ও বিএসসি নাসিং এ অধ্যায়নরত গুঠিয়ার ভাইটশালী গ্রামের শিক্ষার্থী আফরিন জাহান স্বর্না জানান, আমাদের এই পাঠশালায় গ্রামের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক শিক্ষার বাইরে বাহ্যিক জ্ঞান সম্পর্কে অনেক কিছু শেখানো হয়। শিক্ষার্থীরা যাতে এখান থেকে জ্ঞান আহরন নিজের পরিবার, সমাজ তথা সারাদেশকে আলোকিত করতে পারে। শিক্ষার্থী শিল্পী খানম জানায়, এখানে লেখাপড়া, আদব-কায়দা ও বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প শেখানো হয়। তিনি এখানে ভর্তির পর থেকে উলের ব্রুজ, উল ও পুঁথির চুরি, হার, চুল বাধা ব্যান্ড, কাগজের ফুল এবং মাটির আসবাবপত্রে কারুকাজসহ বেশ কয়েকটি হস্তশিল্পের কাজ শিখেছেন। জ্ঞানের পাঠশালার শিক্ষার্থী বাইজিদ ও মুন্নাসহ কমপক্ষে ৫ জন শিক্ষার্থী জানায়, এখানকার লেখাপড়ায় তাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। শুধু লেখাপড়াই নয়, কিভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হবে, শুদ্ধভাবে কোরআন ও হাদীস পড়তে হবে তা শেখানো হয়। এছাড়া বিতর্ক প্রতিযোগীতা, কুইজ প্রতিযোগীতা ও ভাইবা পরীক্ষার প্রস্তুতি সম্পর্কে অনেক কিছু শেখানো হয়। ডহরপাড়া গ্রামের শিক্ষার্থী আবু তালহাজ জানান, সে এই পাঠাশালার একজন নিয়মিত ছাত্র। এখানে পাঠদান না নিলে তার অনেক কিছুই অজানা থাকতো।
সে আরও জানায়, তাদের গ্রামে আগে কোনো পাঠাগার ছিলো না। এখন জ্ঞানের পাঠশালার জন্য তারা একটি পাঠাগার পেয়ে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে পারছেন।
সংগঠনটির উপদেষ্টা ও ডহরপাড়া সামাদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ রফিকুর রহমান তার প্রাক্তন এসব শিক্ষার্থীদের সাদুবাদ জানিয়ে বলেন, জ্ঞানের পাঠশালা সত্যিই এই এলাকায় জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে। এটি যদি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সমাজ আরও ভালোভাবে এগিয়ে যাবে। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম অনেকটা উপকৃত হবে। তবে সংগঠনটতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরও বেশি উন্নতি লাভ করতে পারবে।
শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে জ্ঞানের পাঠশালা সংগঠনটির আরেকজন উপদেষ্টা ও ডহরপাড়া সামাদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোঃ আরজু মিঞা জানান, এটি এলাকার তরুন শিক্ষার্থীদের জ্ঞানী করে তুলছে। ফলে ভবিষ্যতে এসব শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পাঠশালার উদ্যোক্তাদের মতো শহরে গিয়ে কোনো ধরনের হিমশিম খেতে হবে না। তিনি আরও বলেন, জ্ঞানের পাঠশালায় যদি সরকারি কোনো সহযোগীতা দেয়া হয় তাহলে এটি অনেকটা গতিশীল হবে। এতে জ্ঞানের আলোয় আরও আলোকিত হবে ভবিষ্যত প্রজন্ম। শিক্ষার্থীদের এ মহতী উদ্যোগ হতে পারে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।