শামীম আহমেদ ॥ ‘শ্যালা উদারছে ইদারাও-মুক্তি কিয়া আশ্রয় দাও’। এ কথা বলেই আমাদের গ্রামসহ আশপাশের গ্রাম থেকে ধরে আনা ৪৫জন নিরিহ গ্রামবাসী নারী-পুরুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে (ফায়ার স্কট) হত্যা করে পাকিস্তানী মিলিটারীরা। আবেগআপ্লুত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের নিরব স্বাক্ষী বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার কাঠিরা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শতিশ চন্দ্র রায় (৭০)।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আমার বাবা শ্যাম কান্ত রায়সহ ৪৫ জনকে ১৯৭১ সালের ২০মে কাঠিরা গ্রামে বসে ফায়ার স্কট দিয়ে হত্যা করে পাক সেনারা। বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে আমি ভারতে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করছি।
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরেও আমাদের ভ্যাগে জোটেনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের স্বীকৃতি। এমনকি আমার নিজের নামও মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভূক্ত করা হয়নি। তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম অর্ন্তভূক্তির জন্য একাধিকবার সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করেও কোন সুফল মেলেনি।
একই গ্রামের হরেন মধু (৭৭) জানান, পাকসেনারা তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে তার বাবা নারায়ন মধু, কাকা মনোরঞ্জন মধু, জগীন্দ্র নাথ মধু, রনজিত মধুসহ ১৮ জনকে ওই বাড়িতে বসেই হত্যা করে। গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি মনোহর অধিকারী (৯০) জানান, কাঠিরা গ্রামে বিভিন্ন এলাকার সহস্রাধীক মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়েছে।
স্থানীয় রাজাকারদের কাছে পাকসেনারা এমন খবর পেয়ে ৭১’র ২০ মে (রবিবার) সকালে কাঠিরা বাজারে দুইজন ভিক্ষুককে হত্যা করে গ্রামের চারিপাশ ঘেরাও করে। পরবর্তীতে হানাদাররা মুক্তিবাহিনীদের আশ্রয় দেয়ায় কাঠিরা গ্রামের ১৫ জন, ঘোড়ারপাড় গ্রামের সাত জনসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের ৪৫ জন নিরিহ নারী-পুরুষকে ফায়ার স্কট দিয়ে হত্যা করে।
পাক সেনারা ওই ৪৫ জনের লাশ কাঠিরা গ্রামের গীর্জার পার্শ্বের একটি ডোবার মধ্যে ফেলে রাখে। পরে এলাকাবাসী ওই ডোবার মধ্যেই লাশগুলো মাটি চাঁপা দিয়ে রাখেন। দেশ স্বাধীনের পর এলাকার সর্বস্তরের মানুষের দাবি ছিলো ওই বধ্যভূমির ওপর শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করার।
স্থানীয় হিমাংশু কর্মকার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, স্বাধীনতার পর কতো সরকার আইলো আর গ্যালো কেউ শহীদদের স্মরণ করেননি। পরবর্তীতে এলাকাবাসীর সহায়তায় ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সিসিডিবির সহযোগিতায় ১৯৯৭ সালের ২০ মে বধ্যভূমির ওপর একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হয়।
সেই থেকে প্রতিবছর ২০মে এলাকাবাসী বধ্যভূমির শহীদদের স্মরণে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে আসছে। সরকারী উদ্যোগে এখানে আজও কোন কর্মসূচী পালন করা হয়নি। শহীদ পরিবারের সদস্যরা ‘শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি’ পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহত বধ্যভূমি কেতনার বিল ॥ স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময় আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের রাংতা গ্রামের কেতনার বিলে পাক সেনাদের নির্মম বুলেটে প্রায় দুই সহস্রাধিক নিরিহ গ্রামবাসী শহীদ হয়েছিলেন। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহত বধ্যভূমি কেতনার বিল এলাকায় সম্প্রতি সময়ে সরকারী উদ্যোগে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানের কাজ চলছে। রাংতা গ্রামের শহীদ কাশীনাথ পাত্রের পুত্র জগদীশ পাত্র (৬৫) জানান, ঘটনার দিন পহেলা জৈষ্ঠ প্রান বাঁচাতে পালাতে গিয়ে পাকবাহিনীর গুলিতে এলাকার প্রায় দুই সহস্রাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোররা কেতনার বিলে শহীদ হন।
ওইসময় তার বাবার সাথে পালাতে গিয়ে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও তার বাবার শরীরে পাঁচটি গুলিবিদ্ধ হওয়ায় পর ঘটনাস্থলেই সে শহীদ হয়। ওইদিন সকালে চেঙ্গুটিয়া এলাকা দিয়ে হাজার-হাজার লোক জীবন বাঁচাতে কেতনার বিল পাড়ি দিয়ে আগৈলঝাড়ার কোদালধোয়া, রামানন্দেরআঁক ও বাকাল এলাকায় পালানোর সময় অধিকাংশরাই কেতনার বিলের পাশ্ববর্তী কেষ্ট পাত্রের বাড়িতে আশ্রয় নেয়।
যখন পাক সেনারা পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে আসতে থাকে তখন তাদের দেখে দৌঁড়ে পালানোর সময় পাক সেনাদের ব্রাশ ফায়ারে কেতনার বিলে প্রায় দুই সহস্রাধিক লোক ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়।
ওইসময় সমস্ত কেতনার বিল লাশের স্তুপে পরিনত হয়েছিলো। অনেক লাশ শিয়াল, কুকুরে ছিড়ে খেয়েছে। পরেরদিন এলাকার অমূল্য পাত্র ও হরলাল পাত্রের নেতৃত্বে পাত্র বাড়ির বিভিন্নস্থানে ৫/৬টি গর্ত করে অসংখ্য লাশ মাটি চাঁপা দিয়ে রাখা হয়। মাটি দেয়া ছাড়া বাকি লাশগুলো কেতনার বিলেই পচে গলে নষ্ট হয়ে যায়।
অধিকাংশ গণকবর অরক্ষিত ॥ স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকবাহিনী ও স্থানীয় রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের বর্বর নির্যাতনে নিহত শহীদদের ৩৪টি গণকবরের স্মৃতি রক্ষার্থে এখনো বরিশালের অধিকাংশস্থানে নির্মিত হয়নি স্মৃতিস্তম্ভ। যেসবস্থানে সরকারী কিংবা বেসরকারী উদ্যোগে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে তাও অযন্ত অবহেলায় পরে রয়েছে।
সরকারী উদ্যোগে দীর্ঘ ৪৮ বছরে গণকবরগুলো সনাক্ত করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান না করায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
বরিশাল অঞ্চলের বধ্যভূমির সম্ভাব্য তালিকার মধ্যে রয়েছে বরিশাল সদরের পানি উন্নয়ন বোর্ড সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীর তীরে সরকারীভাবে স্তম্ভ নির্মিত বধ্যভূমি (চিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় এক থেকে দেড় হাজার লোক, তালতলী বধ্যভূমি বেসরকারীভাবে ফলক নির্মিত (চিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় অর্ধ শতাধিক।
চরকাউয়া মোসলেম মিয়ার বাড়ি সংলগ্ন খালের পাড় বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় ৩০ থেকে ৪০ জনকে। বরিশাল নগরীর ১নং সিএন্ডবি পুল বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যার শিকার হয় ৮ থেকে ১০ জন। গৌরনদীর বাটাজোর হরহর মৌজার মরার ভিটার বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় দেড় থেকে দুইশ’ জনকে, গৌরনদীর পালরদী নদীর তীরে সহকারী পুলিশ সুপারের অফিসের সামনে বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় দুই থেকে তিন শতাধিক, গৌরনদী গয়নাঘাটা পুল বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় দুই থেকে তিন শতাধিক, গৌরনদী কলেজ সংলগ্ন হাতেম পিয়নের বাড়ির ঘাটলা বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় চার থেকে পাঁচ শতাধিক।
আগৈলঝাড়ার কাঠিরা ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ সংলগ্ন বধ্যভূমি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ফলক নির্মিত (চিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় ৪৫ জনকে, কেতনার বিল বধ্যভূমিতে (চিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় প্রায় দুই সহস্রাধিক। রাজিহার ফ্রান্সিস হালদারের বাড়ির বধ্যভূমি ব্যক্তিগতভাবে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত (চিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় সাত জনকে। পতিহার গ্রাম বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় ১৫ থেকে ২০ জনকে।
দক্ষিণ শিহিপাশা গ্রামের বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয়েছিলো ২০ থেকে ৩০ জনকে। বাকেরগঞ্জের কলসকাঠী বধ্যভূমি ব্যক্তিগতভাবে ফলক নির্মিত (চিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় চার শতাধিক ব্যক্তিকে। বেবাজ বধ্যভূমি এখানে গণহত্যা করা হয় দুইশতাধিক (অচিহ্নিত)। শ্যামপুর বধ্যভূমিতে গণহত্যা করা হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ জনকে (অচিহ্নিত)।
বানারীপাড়ার দক্ষিন গাভা নরেরকাঠী বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ৭৫ থেকে একশত জনকে। গাভা বাজার বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ জনকে। গাভা বিল্ববাড়ি বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় পাঁচ থেকে সাত জনকে। গাভা পূর্ববেড় মহল বাওনের হাট বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ৩৫ থেকে ৪০ জনকে।
গাভা রাম চন্দ্রপুর মহল (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয়েছে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে। বাবুগঞ্জের ক্যাডেট কলেজ বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় অর্ধশতাধিক। উজিরপুর বড়াকোঠা দরগাবাড়ি বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় শতাধিক লোককে। উত্তর বড়াকোঠা মল্লিক বাড়ি বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় আট থেকে ১০জনকে। বড়াকোঠা মুক্তিযুদ্ধের মিলন কেন্দ্র সংলগ্ন বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয়েছিলো অর্ধশত ব্যক্তিকে।
খাটিয়ালপাড়া বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ১৫ থেকে ২০জনকে। বড়াকোঠা চন্দ্র কান্ত হালদার বাড়ি বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ১০জনকে। উজিরপুরের নারায়নপুর বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় প্রায় অর্ধশতাধিক লোককে। মুলাদীর পাতারচর গ্রাম বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ৪৫ থেকে ৫০ জনকে।
মুলাদী নদীর দক্ষিণপাড় বেলতলা বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ১৫ থেকে ২০জনকে। মেহেন্দিগঞ্জ থানা সংলগ্ন বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় আড়াই থেকে তিন শতাধিক। পাতারহাট গার্লস স্কুলের দক্ষিণপাড়ের খলিল মোল্লার বাড়ির বধ্যভূমিতে (চিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ১২জন মুক্তিযোদ্ধাকে। পাতারহাট গার্লস স্কুল সংলগ্ন ব্রীজের গোড়ার বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় শতাধিক ব্যক্তিকে।
ঝালকাঠী জেলার নলছিটি সুগন্ধা নদীর তীরের বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় ১৩ জনকে। নলছিটি মানপাশা ঋষিপাড়া বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় অর্ধশতাধিক গ্রামবাসীকে। স্বরূপকাঠি কুড়িয়ানা খালের বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় প্রায় একহাজার জনকে। কুড়িয়ানা জয়দেব হালদারের বাড়ির বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় চার থেকে পাঁচ শতাধিক। পূর্বজল্লাবাড়ি খালপাড় বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় দুইশতাধিক ব্যক্তিকে। উল্লেখ্য, ঝালকাঠী জেলার নলছিটি, পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠী ও কুড়িয়ানা ১৯৭১ সালে বরিশাল জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিলো।