১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিকের হাতে সপরিবারে জীবন দিতে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তার পরিবারের ছয় বছরের শিশু থেকে শুরু করে অন্তঃসত্ত্বা নারীও সেই দিন ঘাতকের গুলি থেকে রেহাই পায়নি। আজ বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী।
দীর্ঘদিন ধরে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে সরকারি ছুটির দিন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করে এসেছে। যদিও আওয়ামী সরকারের পতনের পর বুধবার (১৪ আগস্ট) ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের সাধারণ ছুটি বাতিল করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ পুরো আগস্ট মাস জুড়ে শোক পালনে নানা কর্মসূচির আয়োজন করত। এবারও সেই রকম ঘোষণা ছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার প্রবল গণঅভু্যত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান।
এরপর দেশের আওয়ামী লীগের কার্যালয় এবং বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য।
এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অনেকে দেশ ছাড়েন। এছাড়া, অনেক নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে যান। ফলে আগস্ট জুড়ে ঘোষিত শোকের মাসের কর্মসূচিগুলো আর হয়নি।
এদিকে, বুধবার (১৪ আগস্ট) আওয়ামী লীগ সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে ভাবগম্ভীর পরিবেশে জাতীয় শোক দিবস ১৫ আগস্ট পালন করার আহ্বান জানান।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, বঙ্গবন্ধু ভবনে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও দোয়া মোনাজাত করে সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বাংলাদেশের মানুষের মঙ্গল করুন।
দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। সে জন্য পোস্টার বানিয়ে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক আরিফুর রহমান রাসেল বলেন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ যথাযথ মর্যাদার সাথে ১৫ আগস্ট পালন করবে।
কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ থেকে একটি কর্মসূচি পেয়েছি, সেই অনুযায়ী মহানগর আওয়ামী লীগ কর্মসূচি পালন করবে।
তিনি আরও বলেন, ১৫ আগস্ট সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, সাড়ে আটটায় বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে মিলাদ মাহফিল, সকাল ৯টায় ধানমন্ডি ৩২ থেকে কলাবাগান মাঠ হয়ে আবার ধানমন্ডি ৩২ পর্যন্ত শোক র্যালি এবং ১০টায় বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে সারা দেশে জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি পালিত হত। ঢাকার পাশাপাশি বড় আয়োজন থাকত গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায়, সেখানেই বঙ্গবন্ধুর সমাধি।
টুঙ্গিপাড়া আওয়ামী লীগ এবারও জাতীয় শোক দিবস পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ১৫ আগস্ট সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ, বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, দোয়া ও মোনাজাত, আলোচনা সভা এবং দারিদ্র্যদের মাঝে খাবার বিতরণেন মত কর্মসূচি রয়েছে।
প্রতি বছর সকাল সাড়ে ৬টায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতেন। তবে এবার তা আর হচ্ছে না।
প্রায় ৪৮ বছর আগে এই বঙ্গবন্ধু ভবনেই ঘাতকরা হানা দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরকে হত্যা করে তারা।
সেই রাতেই নিহত হন বঙ্গবন্ধুর বোনের স্বামী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবী ও শিশুপুত্র সুকান্ত বাবু; বঙ্গবন্ধুর ভাগনে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, নিকটাত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত ও রিন্টু।
এছাড়া, বঙ্গবন্ধু ভবনে পুলিশের বিশেষ শাখার সাব ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমান ও ভবনের অদূরে নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলকেও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সে সময় প্রাণে বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধুকে জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় দাফন করা হলেও পরিবারের অন্য সদস্যদের ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রলীগ গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় আসেন তিনি।
এরপর বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন ও ছেষট্টির ছয় দফা প্রণয়নে ভূমিকা রেখে এবং ১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি হিসেবে শেখ মুজিব বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন।
১৯৬৯ এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কারামুক্ত হন শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর তাকে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করে ছাত্র-জনতা। ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) স্বাধীনতার ডাক দেন তিনি।
তার নেতৃত্বে রক্তাক্ত সংগ্রামেই অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। আর স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের।
১৯৭৫-এর পর ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পালিত হয়ে আসছে ১৫ আগস্ট। ’৭৫ এর পর ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে দিনটি পালিত হয়নি।
২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু হয়। তবে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর মামলার গতি শ্লথ হয়ে যায়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর মামলার বিচার চূড়ান্তভাবে শেষ করার পর ২০১০ সালে পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার দণ্ডিত ছয় খুনি এখনও বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছেন।