নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সোমবার অবতরণের সময় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের বিএস ২১১ ফ্লাইট বিধ্বস্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই দুর্ঘটনার পর থেকেই নিহতদের পরিবার-স্বজনদের পাশাপাশি অনেকে শোকে কাতর হয়ে পড়েছেন।
একসঙ্গে এত মানুষের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কেউই। এই কষ্টের ঢেউ লেগেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও। অনেকে নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে পরিচিতদের স্মৃতিচারণ করে শোক সামলানোর চেষ্টা করছেন। আবার কেউবা তার প্রিয় মানুষের সঙ্গে মিশে থাকা কোনো স্মৃতি তুলে ধরে হাহাকার করছেন। অনেকে পরকালে তাদের শান্তির জন্য দোয়া কিংবা নিহতদের পরিবারকে শান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন।
দুর্ঘটনায় নিহত ফটোগ্রাফার এফ এইচ প্রিয়কের কথা স্মরণ করে তার বন্ধু স্টিভ তুর্য এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ”আমার বন্ধু ‘প্রিয়ক’ আলোকচিত্রী। নেপালের বিমান দুর্ঘটনায় চলে গেল না ফেরার দেশে।সাথে চলে গেছে তার ছোট রাজকন্যাটি। আর কোনোদিন কথা হবে না। শেষ এই কবিতাটি পাঠিয়েছিল”-
‘‘জীবনসঙ্গবাসে যদি কেউ শোনাতো গান
নিরলে প্রিয়কর মহিমায়
তাকে প্রজাপতির স্বাধীনতা দিতাম।
কুয়াসার অভিমান ভেঙে নিয়ে যেতাম তারে
আরও আঁধার গহীন সুরঙ্গপথে
নিরন্তর আলোকের অভিলাষে
ভালোবেসে আরও উত্তাল তরঙ্গে আরও বহুদূর
সুরশ্রী বন্যবাসে।’’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজনের) প্রোগ্রাম অফিসার সানজিদা বিপাশার কথা স্মরণ করে স্ংবাদিক আরাফাত সিদ্দিক তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন,
‘‘৮ মার্চের ফোনালাপ।
-আরাফায়য়য়ত….
-জ্বি আপা, বলেন।
-বিপাশা বলছি!
-আপা, আপনার ফোন নম্বর আমি আট বছর আগে সেভ করে রেখেছি। কেনো প্রত্যেকবার নিজের পরিচয় দেন?
-আর বলো না, অভ্যাস হয়ে গেছে, আত্মীয় স্বজনকে ফোন দিলেও মাঝে মাঝে নিজের নাম বলে ফেলি। হা হা হা.. কোথায় আছো, অফিসে?
– না আপা, ছুটিতে আছি একদিনের।
– শোনো, কাল আমাদের প্রোগ্রাম আছে, শিশু একাডেমিতে, তার আগে শাহবাগ থেকে টিএসসিতে র্যানলী হবে। এটা কিন্তু সুজনের প্রোগ্রাম না, কন্যা শিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের অনুষ্ঠান। নারী দিবস নিয়ে। এসব কেমন জানি তোমরা কাভার করো না। এটা অবশ্যই কাভারেজ দেয়ার চেষ্টা করবা।
-আচ্ছা আপা, আপনি আমাকে SMS দেন, আমি অফিসে ফরওয়ার্ড করে দিচ্ছি।
– সেটা দিচ্ছি, তোমার ছেলে স্লোগান কেমন আছে। মাশআল্লাহ তোমাদের ছবি দেখি ফেসবুকে।
-আছে আপা ভালো।
-ঠিক আছে আরাফাত, ভালো থেকো।
-জ্বি আপা, স্লামালেকুম।
‘‘Sanzida Huque বিপাশা আপার সাথে হুবহু এমনই ফোনালাপ হতো কয়েকদিন পর পরই। ড. বদিউল আলম মজুমদার স্যারের ইন্টারভিউ নিতে অফিসে গেলেই আপার সাথে দেখা হতো। কিছু মানুষ থাকে যার সাথে দেখা হলেই অটোমেটিক মুখটা হাসি হাসি হয়ে যায়। বিপাশা আপা তেমনই একজন। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের গোলটেবিল বৈঠকগুলোতে আপার সাথে বেশি দেখা হতো। তিনিই সাধারণত অতিথী ও মিডিয়ার সাথে আগের দিন ফোনে আমন্ত্রন জানাতেন।প্রেসক্লাবে গোলটেবিল বৈঠক কাভার করতে গিয়ে সম্পর্কের খাতিরে বিপাশা আপার কানে কানে বলতাম, এসব প্যাচাল আর কতদিন চালাবেন আপনারা ! একই কথা, একই মুখ, একই বিষয়। আপা হাসতেন, আস্তে করে তিনি বলতেন, কি করবা বলো। কোন কিছুর তো সমাধান হচ্ছে না। অনুষ্ঠানের কাগজপত্র নিয়ে তার মুখোমুখি সাংবাদিক আসনে গিয়ে বসতাম। পুরো বক্তৃতা অনুষ্ঠান তিনি নোট নিতেন। আমাদের চোখাচোখি চলতো। বক্তাদের একঘেয়ে বক্তব্যের সময় আমি শিশুসুলভ ভাবে বিপাশা আপার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটতাম। তিনি বড় বোনের প্রশ্রয়ের হাসি দিতেন, চোখ ফিরিয়ে লিখতেন। সেমিনার রুম ভর্তি মানুষ থাকতো, তবে কেউই আমাদের এই অবাচনিক যোগাযোগ টের পেতো না। ১২ মার্চ, ২০১৮।
ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে বিপাশা আপা তার স্বামী ও বাচ্চাসহ নেপাল যাচ্ছিলেন। জীবিতদের তালিকায় তাদের নাম নেই।’’
আরেক নিহত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শশীর স্মৃতিচারণ করে বন্ধু ওয়ালিউর রহমান লিখেছেন, ‘‘শশীর সাথে প্রথম দেখা হয় ক্যাপ্রিকনে আমাদের ব্যাচের গেট টুগেদার এ। সেইদিনই আমার বউ তার অনেক প্রশংসা করলো। এর পর থেকেই সে আমার আইডি থেকে লগ ইন করলেই Shaon আর Shashi র পিকচার দেখতো, আর একটাই ডায়ালগ দিত – ” তোমার বন্ধুর কাছ থেকে ভালবাসা শেখো, তুমি তো ঘুরতেই যেতে চাও না আর ওদের দেখো “। আসলে প্রফেশনাল ব্যস্ততা, পড়াশুনার চাপে সত্যিই আমি শাওনের মত পারি নি। তবে আমিও অকপটে স্বীকার করতাম ওরা সত্যি হ্যাপি কাপল। আজ খুব কষ্ট হচ্ছে যে আল্লাহ এই ভালবাসা বেশিদিন রাখলেন না। এত ভালবাসা এত অল্প সময়ে বিচ্ছেদ। আল্লাহ তুমি ভালো জানো কেন তোমার এত কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত???
আল্লাহ, পরকালেও ওদের এই ভালবাসা অটুট রাখুন’’
একই সঙ্গে শশী ও শাওনের আনন্দঘন মুহূর্তের কিছু ছবিও শেয়ার করেছেন তিনি।
নিহত ফটোগ্রাফার প্রিয়ক ও তার স্ত্রী-কন্যার ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে ফাহাদ ফয়সাল নামে একজন লিখেছেন, ‘আর কখনই কি ফেসবুকে প্রিয়কের ছবি গুলো দেখা হবে না!!!’
শুধু তুর্য, আরাফাত, ওয়ালিউর আর ফাহাদ নন, তাদের মতো বহু মানুষের শোকগাঁথায় ভরে গেছে ফেসবুক। সবার স্ট্যাটাসে স্বজন হারানোর বেদনা।