ফিরে দেখা ২০১৭- পদহীন পদোন্নতির বিশৃঙ্খলা, চূড়ান্ত হয়নি কর্মচারী আইন

:
: ৭ years ago

সময়ের নিয়মে শেষ হচ্ছে আরও একটি বছর। চলে যাওয়া সময়ের সব ঘটনার স্থান হয় স্মৃতির খাতায়। ২০১৭ সালে দেশের প্রশাসনেও ছিল নানা ঘটনার ঘনঘটা। তবে জনপ্রশাসনে এই বছর নতুন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

স্থায়ী পদ না থাকার পরও দফায় দফায় পদোন্নতিতে এই বছর প্রশাসনের বিশৃঙ্খলা আরও বেড়েছে। যথারীতি চলতি বছরেও আলোর মুখ দেখেনি বহুল প্রতীক্ষিত সরকারি কর্মচারী আইনটি। একজন ইউএনও’র বিরুদ্ধে মামলা করাসহ হয়রানির ঘটনা প্রশাসনে ব্যাপক আলোড়ন তোলে এই বছরই। ২০১৭ সালেই মারা যান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক। আর মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া নানা আইন ও নীতিমালা নিয়ে বছর জুড়ে আলোচনা-সমালোচনা তো ছিলই।

পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তার পদোন্নতি
চলতি বছর তিন দফায় অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপ-সচিবসহ বিভিন্ন পদে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়।

প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব ও উপ-সচিব হিসেবে এমনিতেই নিয়মিত পদের চেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মকর্তা রয়েছেন। তার উপর আবার পদোন্নতিতে প্রশাসনে আরও বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে বলে মনে করছেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। পদোন্নতি পাওয়ার পরও অনেককে নিচের পদে কাজ করছেন।

গত কয়েক মাস ধরে জনপ্রশাসনে তিনস্তরে পদোন্নতির গুঞ্জন ছিল। সর্বশেষ গত ২১ ডিসেম্বর গভীর রাতে ১৯৩ উপ-সচিবকে যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। এর আগে ১১ ডিসেম্বর প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পান ১৩৩ জন যুগ্ম-সচিব।

এখন প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা হল ৫৬০ জন। যদিও অতিরিক্ত সচিবের স্থায়ী পদের সংখ্যা ১২১টি। অপরদিকে প্রায় ৪০০ যুগ্ম সচিবের স্থায়ী পদের বিপরীতে এখন যুগ্ম সচিব ৮৪২ জন।

স্থায়ী পদ না থাকায় প্রশাসনে আগে থেকেই বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা নিচের পদে কাজ করছিলেন। এমন ব্যবস্থায় নতুন করে যুক্ত হলেন এ বছরের পদোন্নতিপ্রাপ্তরা। এতে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা আরও বেড়েছে বলে মনে করছেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।

অপরদিকে, অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির পর সব ধরণের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দুই শতাধিক কর্মকর্তার বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে শতাধিক কর্মকর্তার বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

এর আগে গত ২৩ এপ্রিল প্রশাসনে সিনিয়র সহকারী সচিব ও সমমর্যাদার ২৬৭ কর্মকর্তাকে উপ-সচিব পদে পদোন্নতি দেয় সরকার।

এখন উপ-সচিবের সংখ্যা এক হাজার ৩৫৮ জন। উপ-সচিবের নিয়মিত পদ সাড়ে আটশ’র মতো। কিন্তু প্রশাসনের একেবারে নিচের দিকে কর্মকর্তা সংকট রয়েছে।

সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদেও পদোন্নতি শিগগিরই আসছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে।

গত ১২ অক্টোবর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ১৮ প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে (পিও) নন-ক্যাডার কোটায় সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

আলোচিত আইন-নীতিমালা
২০১৭ সালে মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনেক আইন ও নীতিমালা অনুমোদন পেয়েছে। এরমধ্যে কতগুলো আইন ও নীতিমালা ছিল নানান কারণে আলোচিত।

বছরের ২৭ মার্চ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে মোটরযান চালকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি করতে বিশিষ্টজনদের দাবি থাকলেও তা অষ্টম শ্রেণি রেখেই ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৭’ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এছাড়া নানা ধরনের অনিয়মের জন্য এই আইনে শাস্তির পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে।

৩১ জুলাই বিদ্যুৎ স্থাপনায় নাশকতার জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছরের জেল বা ১০ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রেখে ‘বিদ্যুৎ আইন, ২০১৭’ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।

গত ২৭ জুলাই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনে নিকটাত্মীয়ের পরিধি বাড়িয়ে ‘মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন, ২০১৭’ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এই আইনানুযায়ী, সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো হাসপাতাল মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন করতে পারবে না।

অন্যান্য গণমাধ্যমের মতো অনলাইন গণমাধ্যমগুলোকে সম্প্রচার কমিশনের কাছ থেকে নিবন্ধন নেয়ার বিধান রেখে ১৯ জুন ‘জাতীয় অনলাইন নীতিমালা, ২০১৭’ অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

মন্ত্রিসভা শাস্তি বাড়িয়ে ‘আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুতবিচার)(সংশোধন) আইন, ২০১৭’ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয় ৫ জুন।

১৫ মে সেনানিবাস (ক্যান্টনমেন্ট) এলাকায় মলমূত্র ত্যাগ, মাতলামী ও ভিক্ষাবৃত্তি করলে ২০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রেখে ‘সেনানিবাস আইন, ২০১৭’ খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

বেসরকারি ব্যাংকে একই পরিবারের দুইজনের পরিবর্তে চারজন সদস্যকে পরিচালক করার বিধান রেখে ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০১৭’ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এই খসড়াটি অনুমোদন দেয়া হয় ৮ মে।

গত ৩ এপ্রিল ‘জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা-২০১৭’ অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এই নীতিমালা অনুযায়ী, চলচ্চিত্রে সরাসরি কোনো ধর্ষণের দৃশ্য দেখানো যাবে না। এছাড়া অপরাধীদের কার্যকলাপের কৌশল প্রদর্শন যা অপরাধের ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন ও মাত্রা আনতে সহায়ক হতে পারে এমন দৃশ্য পরিহার করতে হবে।

দেশের যে কোনো স্থানে উন্নয়ন কাজে ভূমি ব্যবহারে সরকারের ছাড়পত্র নিতে হবে। এমন বিধান রেখে গত ২০ মার্চ ‘নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন, ২০১৭’ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

একই দিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়।

বিমান পরিচালনায় বাধা দিলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা জরিমানার বিধান রেখে ১৩ ফেব্রুয়ারি ‘বেসামরিক বিমান চলাচল আইন, ২০১৭’ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।

চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি যৌতুকের জন্য মারাত্মক যখম করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখে ‘যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৭’ এর খসড়া মন্ত্রিসভা বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন পায়।

ইউএনও তারেক সালমান ইস্যু
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ‘বিকৃত’ করে স্বাধীনতা দিবসের দাওয়াতপত্র ছাপানোর অভিযোগে বরগুনার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী তারেক সালমানকে মামলাসহ হয়রানির ঘটনা প্রশাসনে ব্যাপক আলোড়ন তোলে এ বছর।

ইউএনও’র বিরুদ্ধে মামলা করা আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ ওবায়েদুল্লাহকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

ইউএনওকে হয়রানির ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার জন্য গত ২৪ জুলাই বরিশালে জেলা প্রশাসক (ডিসি) গাজী মো. সাইফুজ্জামান ও বরগুনার ডিসি বশিরুল আলমকে ওএসডি করা হয়।

শেষে চলতি বছরের ৩ আগস্ট গাজী সালমান তারিককে বদলি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব করা হয়।

চলতি বছর সচিব হয়েছেন ২২ জন
চলতি বছর ২২ জন অতিরিক্ত সচিবকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

এরমধ্যে ২৩ ফেব্রুয়ারি একজন, ৩ এপ্রিল একজন, ২৩ এপ্রিল একজন, ১০ জুলাই নয়জন, ২৪ জুলাই একজন, ১৩ আগস্ট পাঁচজন, ২৯ নভেম্বর চারজন কর্মকর্তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দুই বিভাগ
কাজের সুবিধার্থে দীর্ঘদিন ধরেই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বিন্যস্ত করে দুটি বিভাগ করার বিষয়টি আলোচিত হলেও চলতি বছরের ১৬ মার্চ তা বাস্তবায়ন হয়। পুনর্গঠিত দুটি বিভাগের একটি ‘স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ’, অপরটি ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ’।

এরপর দুই বিভাগে দুইজন সচিব নিয়োগ দেয়া হয়।

আলোর মুখ দেখেনি সরকারি কর্মচারী আইন
বহুল আলোচিত ‘সরকারি কর্মচারি আইন’ ২০১৭ সালেও আলোক মুখ দেখেনি। এ আইনের খসড়াটি চলতি বছরও মন্ত্রিসভার চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।

বহু আলোচনার পর ২০১৫ বছরের ১৩ জুলাই সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। আইনের খসড়াটি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিং (পরীক্ষা-নীরিক্ষা) শেষে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবার মন্ত্রিসভায় উত্থাপনের কথা ছিল। এক বছর চার মাস পর গত বছরের ২৪ নভেম্বর মন্ত্রিসভা বৈঠকে খসড়াটি উত্থাপন করা হয়।

কিন্তু মন্ত্রিসভা আইনের খসড়াটি চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়নি। সিদ্ধান্ত হয় এটি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আবারও পেশ করা হবে। কিন্তু এটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

সরকারি কর্মচারী আইন প্রণয়নে বিলম্ব হওয়ায় জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক অসন্তোষ প্রকাশ করে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ারও নির্দেশনা দেন।

জানা গেছে, সম্প্রতি প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির বৈঠকে আইনটি ফের পর্যালোচনা করার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইনকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ, পদোন্নতি, জ্যেষ্ঠতা, ছুটি, পদায়ন, প্রেষণ, লিয়েন, ক্যাডার সার্ভিস, শৃঙ্খলা ও আচরণ, অবসর, পদত্যাগ, স্বেচ্ছা অবসর ও অক্ষমতাজনিত অবসর, পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা ও কর্মমূল্যায়ন, ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও দক্ষতা উন্নয়ন, উচ্চ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে সমন্বিত কোনো আইন নেই।

আইন প্রণয়ন না করে সরকারগুলো বিধি, নীতিমালা ও প্রয়োজন মতো নির্দেশনাপত্র জারি করে সরকারি কর্মচারীদের পরিচালনা করে আসছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, খসড়া হয়েছে। কিন্তু ভেস্তে গেছে সে সব উদ্যোগ।

চলে গেলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক
গত ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক মারা যান। ছায়েদুল হক দীর্ঘদিন ধরে জ্বর, ইউরিন ইনফেকশন ও শারীরিক দুর্বলতায় ভুগছিলেন। তিনি আগস্ট মাস থেকে প্রোস্টেট গ্লাণ্ডের সংক্রমণে ভুগছিলেন এবং ১৩ ডিসেম্বর থেকে হাসপাতালের আইসিইউ-এর ১৬ নম্বর বেডে লাইফ-সাপোর্টে ছিলেন।

প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এখন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন। ২৭ ডিসেম্বর এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এই মন্ত্রণালয়ের কোনো নতুন মন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়নি।