ফিরে দেখা ১৫ আগস্ট : “চোখের সামনে সন্তানের নির্মম মৃত্যু দেখেছি”

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

সূর্যের কিরণ তখনও চারপাশ আলোকিত করেনি। ফজরের আযানের সুরেলা ধ্বনি চারিদিক থেকে সুধা ঢালছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের এমনই একসময় অতর্কিত হামলায় কেঁপে উঠলো ঢাকার ২৭নং মিল্টো রোডের বাড়িটি। যা বর্তমানে ঢাকা মহানগর পুলিশের সদরদপ্তর। ঘাতকদের আগমনে ভীত চার বছরের শিশু সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত আশ্রয় চাইলেন মা শাহানারা আব্দুল্লাহর কোলে। কিন্তু মমতাময়ী মা তার আদরের ছোট্ট শিশুপুত্রকে আর কোলে নিতে পারেননি। তার আগেই ঘাতকেরা মায়ের চোখের সামনেই নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতকে।

অশ্র“সজ্জল নয়নে সেইদিনের লোমহর্ষক ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সিনিয়র সহসভাপতি বেগম শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন, “বাবু আমার কোলে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিন আমি বাবুকে কোলে নিতে পারিনি। চোখের সামনেই সন্তানের নির্মম মৃত্যু দেখলেও কিছুই করতে পারিনি”। বলেই অনেকটা স্তব্দ হয়ে যান তিনি। সূত্রমতে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল কাল রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলার পাশাপাশি তার বোনজামাতা ও দক্ণিাঞ্চলের কৃষককুলের নয়নমনি তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ২৭নং মিন্টো রোডের বাড়িতেও হামলা করে ঘাতকেরা। সেখানে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ ছয়জনকে হত্যা করা হয়। এরমধ্যে চার বছরের শিশু সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতও ছিলেন।

মমতাময়ী মা শাহানারা আব্দুল্লাহ আলাপচারিতার শুরুতেই বলেন, ‘সেদিন (১৫ আগস্ট) ফজরের আযানের পর আমরা প্রচন্ড গুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। শব্দ আমাদের বাসার দিকেই আসছিল। গুলির শব্দে হঠাৎ করে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। আমার শ্বাশুড়ি (বঙ্গবন্ধুর বোন আমেনা বেগম) বলেন, ‘বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, ডাকাত পড়েছে, আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দাও’। আমার শ্বশুর আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বঙ্গবন্ধুকে একটা ফোনও করেছিলেন। কিন্তু কি কথা হয়েছে, বলতে পারবো না। এরইমধ্যে আমি শেখ ফজলুল হক মনি ভাইকে ফোন করলাম। ফোনে তাকে বললাম, আমাদের বাড়ির দিকে কারা যেন গুলি করতে করতে আসছে, বুঝতে পারছিনা। মনি ভাই বলেন, কারা গুলি করছে দেখো। বললাম, বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না।

মনি ভাই বলেন, তারপরেও দেখো, কারা আসছে। এরমধ্যে ফোনটি আমার হাত থেকে টেনে নিয়ে আমার শাশুড়ি মনি ভাইকে বলেন, বাবা বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, আমাদের বাঁচাও। এই কথা বলেই ফোন রেখে দিয়ে আমার শাশুড়ি আমার শ্বশুরকে বললেন, কি ব্যাপার তুমি আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দিলা না? আমার শ্বশুর বলেন, তোমার ভাইও মনে হয় রেহাই পায়নি। ওনার সাথে কি কথা হয়েছে আমরা সেটা শুনিনি। আমাদের দরজা ভাঙ্গার শব্দ পাচ্ছিলাম। এমন সময় একটা চিৎকার শুনলাম, তোমরা সামনে এগুবে না, ভালো হবেনা। এসময় ওরা (ঘাতকেরা) থমকে দাঁড়ায়। ওই চিৎকারটি দিয়েছিলেন আমার স্বামী (আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ)। এরপর উনি দোতলায় চলে যান। কাজের বুয়া দরজাটা বন্ধ করে দেয়। দরজা বন্ধ করে দেয়ার পর উনি আমাদের ঘরে না ঢুকে ডান পাশের রুমে ঢুকে যান। পরে আমরা জানতে পারি, একটা ফোন আসে (ফোনটি রিসিভ করে হাসানাত) মনি ভাই মারা গেছেন।’

অশ্র“সজ্জল নয়নে শাহানারা আব্দুল্লাহ আরও বলেন, এরমধ্যে ঘাতকেরা বাড়ির দরজা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে। তারা রুমে রুমে ঢুকে হ্যান্ডস আপ হ্যান্ডস আপ বলে আমাদের সবাইকে কর্ডন করে নিচতলার ড্রইংরুমে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাখে। সিঁড়ির অর্ধেক নেমেই বাবু (সুকান্ত বাবু) বলে, মা আমি তোমার কোলে উঠবো। আমি ওকে কোলে নিতে পারলাম না। পাশে আমার ভাসুর (শহিদ সেরনিয়াবাত) ওকে কোলে নিল। নিচে নামার পর ভাড়ি অস্ত্র ঠেঁকিয়ে ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করে উপরে আর কে কে আছে? এমন সময় আমার শ্বশুর আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন তার চোখের ইশারায় আমি বললাম, ওপরে আর কেউ নেই। যেকারণে উপরের রুমগুলো তল্লাশী না হওয়ায় আমার স্বামী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহকে ওরা খুঁজে পায়নি। শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন, ‘তখনও আমরা বুঝতে পারছিলাম না ওরা আমাদেরকে মারতে এসেছে, না গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। আমার শ্বশুর ওদেরকে বললো, তোমরা কি চাও। তোমাদের কমান্ডিং অফিসার কে। ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে, আমরা কিছুই চাই না, আমাদের কোনো কমান্ডিং অফিসার নেই। এই কথা বলার সাথে সাথেই ঘাতকেরা ব্রাশ ফায়ার করে। আমরা মাটিতে পরে যাই।’

এ কথা বলতেই শাহানারা আব্দুল্লাহর চোখ বেয়ে জল পড়তে শুরু করে। কন্ঠ ভারি হয়ে ওঠে। কিছু সময়ের জন্য চুপ থেকে চোখের জল মুছে শাহানারা আব্দুল্লাহ আবার বলতে শুরু করলেন, ‘শহিদ ভাইকে ঠেঁকিয়ে ওরা গুলি করে। উনি সাথে সাথে উপুর হয়ে পরে যান। আমার শ্বশুরের শরীর দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিলো। আমার শরীরের পিছনের অংশে হাত দিয়ে দেখি রক্ত বের হচ্ছে। ওরা চলে যেতে লাগল। তখনও আমার জ্ঞান ছিলো। এরমধ্যেই কে যেন কান্না করে ওঠে। এরপর ঘাতকরা আবার দৌঁড়ে এসে ব্রাশ ফায়ার করে। এবার ওরা নিচ দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। আমার শ্বশুর সাথে সাথেই মারা যান।

আমি আমার শ্বশুরের পিছনে ছিলাম, আমার কোমরে গুলি লাগে। ব্রাশ ফায়ারে ছয়জন মারা যায়। আমরা গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষনে নয়জনে কাতরাচ্ছিলাম। এরমধ্যে আবার একদল লোক গাড়ি নিয়ে আসে। তখন ভাবলাম এই বুঝি শেষ। কিন্তু পরে দেখি রমনা থানার পুলিশ এসেছে। তারা আমার শ্বশুরের পালস্ দেখে বলে, বাড়ির কেউ আহত আর কেউ মারা গেছে। দীর্ষ নিঃশ্বাস ফেলে মমতাময়ী শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন, ‘পুলিশ আসার পর বাবুকে শহিদ ভাইয়ের বুকের নিচ থেকে উঠানো হল। দেখালাম ওর নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পরছে। কিছু সময় আগে যে সন্তান আমার কোলে উঠতে চেয়েছিল, তাকে কোলে নিতে পারি নাই, সেই আদরের সন্তানের নিথর দেহ আমার চোখের সামনে। ছেলের ছবির অ্যালবামে হাত বুলিয়ে পুরনো স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন মমতাময়ী মা শাহানারা আব্দুল্লাহ।

ছেলের স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমার বাবু ছিল অসম্ভব মা ভক্ত। আমি যখন যা বলতাম তা মেনে নিতো। ও মাঝে মধ্যে বলতো মা তোমাকে ছেড়ে অনেক দূরে ঘাসের মধ্যে গিয়ে শুয়ে থাকবো।’ এই কথা বলেই দীর্ঘসময় তার (শাহানারা আব্দুল্লাহর) কথা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে আবার শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ওর জন্ম ১৯৭১ সালের ২২জুন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ওকে বুকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে দৌঁড়িয়েছি। একদিকে আর্মি অন্যদিকে রাজাকার। আমার স্বামী (আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ) বরিশাল অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন।

রাজাকাররা পেলেই আমাদের মেরে ফেলবে। এই আতংকে ছিলাম। যুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘদিন হাসানাতের সাথে দেখা হয়নি। পরে একটি চিরকুট পেলাম। তিনি পয়সারহাট এসেছেন। সেখানে গিয়ে দেখা করি। সেই সময়ে বাবুকে বুকে নিয়ে আজকে এই বাড়ি কালকে ওই বাড়িতে দিন পাড় করেছি। ওইসময় গ্রামে দুধতো দূরের কথা ভাতও ঠিকমতো পাওয়া যায়নি। ভাত টিপে টিপে নরম করে বাবুকে খাইয়েছি। বাবু রাজত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলো। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। আবার ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সাথে ও (সুকান্ত বাবু) চলে গেল। বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পরেন সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতের হত্যভাগ্য মা শাহানারা আব্দুল্লাহ।

সেই ভয়াল কালরাতে তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ঢাকার মিন্টো রোডের বাসায় বরিশালের ছয়জন নারী-পুরুষ নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন। তারা হলেন, সাবেক মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর বোনজামাতা কৃষককুলের নয়নমনি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ভাইয়ের ছেলে সাংবাদিক শহিদ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতী সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত এবং বরিশালের ক্রিডেন্স শিল্পগোষ্ঠীর সদস্য আব্দুর নঈম খান রিন্টু। আহত হয়েছিলেন নয়জন। তারা হলেন, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সহধর্মীনি আমেনা বেগম, বেগম শাহানারা আব্দুল্লাহ, বিউটি সেরনিয়াবাত, হেনা সেরনিয়াবাত, আবুল খায়ের আব্দুল্ল¬াহ, রফিকুল ইসলাম, খ.ম জিল্লুর রহমান, ললিত দাস ও সৈয়দ মাহমুদ।