বর্তমানে প্রশাসনের উচ্চপদে ৫৩৫ জন নারী দায়িত্ব পালন করছেন। কোনো ক্যাডারের নয় সরকারের পদ হিসেবে বিবেচিত উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলোতে এ নারী কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন।
নারী কর্মকর্তা ও সিভিল সার্ভিসের নারী কর্মকর্তাদের সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, নীতি-নির্ধারণী হিসেবে বিবেচিত এসব পদে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে নারীরা ভালো অবস্থানে রয়েছেন। তবে নারীরা যে হারে চাকরিতে আসছেন সেই তুলনায় নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের সংখ্যা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেই। এ জন্য দায়িত্বশীল পুরুষ সহকর্মীদের কাছ থেকে আরও নারীবান্ধব মানসিকতা আশা করছেন তারা।
বর্তমানে প্রশাসনে সিনিয়র সচিব, সচিব ও ভারপ্রাপ্ত সচিব রয়েছেন ৭৮ জন। এরমধ্যে নারী কর্মকর্তা রয়েছেন ৬ জন। নারীদের হার প্রায় ৮ শতাংশ।
বৃহস্পতিবারের (৭ মার্চ) তথ্য অনুযায়ী, নারী অতিরিক্ত সচিব রয়েছেন ৮১ জন, মোট অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা ৫২৬ জন। ৭৩৮ জন যুগ্ম-সচিবের মধ্যে নারী রয়েছেন ৮৭ জন। প্রশাসনে নারী উপসচিব রয়েছেন ৩৬১ জন, বর্তমানে মোট উপসচিবের সংখ্যা এক হাজার ৮৪০ জন।
বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের মহাসচিব ও জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালকের (সচিব পদমর্যাদার) পদ থেকে কয়েক মাস আগে অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়া নাসরিন আক্তার বলেন, ‘বর্তমানে প্রশাসনে নারীদের অবস্থান আগের চেয়ে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। নারীরা সংখ্যায় আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। মাঠ পর্যায়ে সব জায়গায় এখন আমাদের প্রতিনিধিত্ব আছে। এসিল্যান্ড থেকে শুরু করে ইউএনও, ডিসি- সব জায়গায়ই নারীরা রয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘তবে ডিসিশন মেকিংয়ের (নীতি-নির্ধারণী) যে পর্যায় রয়েছে আমরা যেটাকে ধরি যুগ্মসচিব এবং এর উপরের পদ অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পর্যায়ে নারীদের প্রতিনিধিত্ব ততটা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে আসেনি।’
‘আমরা মনে করছি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা আরও নারীবান্ধব হওয়া প্রয়োজন। নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিটা রাতারাতি পরিবর্তন হওয়ার নয়। এটা আস্তে আস্তে হবে। আমরা যদি আরকেটু নারীবান্ধব পরিস্থিতি বা পরিবেশ পাই তাহলে হয়তো আমাদের উত্তরণটা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে যাবে।’
মহাসচিব আরও বলেন, ‘তবে আমরা খুবই ভাগ্যবান যে শেখ হাসিনার মতো একজন নেতৃত্ব আমাদের সামনে আছে। উনার পক্ষ থেকে আমরা যেটা পাচ্ছি সেটাতে আমরা হ্যাপি। এরসঙ্গে আরও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো আছে সেগুলো আরেকটু নারীবান্ধব হওয়া প্রয়োজন।’
বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের উপদেষ্টা (সর্বশেষ সরকারি কর্মকমিশনের সচিব পদ থেকে পিআরএলে গেছেন) আকতারী মমতাজ বলেন, ‘আপনি যদি মাঠ পর্যায়ে তাকান তবে দেখবেন বেশ ভালো, মেয়েরা দায়িত্বশীল বিভিন্ন পদে আসছেন, কাজ করছেন। কিন্তু উপরের দিকে হয়তো একটু সমস্যা আছে। তবে আগের তুলনায় বেটার।’
‘আমরা দেখেছি প্রধানমন্ত্রী কারও প্রতি যদি নজর দেন তবে হয়তো তিনি…কিন্তু নারীদের এগিয়ে দেয়ার মতো সে রকম কেউ নেই। নারীদের এগিয়ে দেয়ার পথ করে দিতে দায়িত্বে থাকা পুরুষ সহকর্মীরা সেভাবে দায়িত্ব নিতে পারেন না,’যোগ করেন আকতারী মমতাজ।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আকতারী মমতাজ আরও বলেন, ‘আমরা সচিব পর্যন্ত গিয়েছি। আমাদের সেভাবে কেউ এগিয়ে দেয়নি, কেউ এগিয়ে দেয় না। তারপরও বলব প্রশাসনে নারীদের অবস্থানটা আগের চেয়ে সুদৃঢ় হয়েছে।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে সর্বশেষ ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে মোট নারীর সংখ্যা ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৮১৯ জন।
নারীদের মধ্যে প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কর্মরত রয়েছেন ৩০ হাজার ৪২ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৪০ হাজার ৫৬৩ জন। সবচেয়ে বেশি নারী রয়েছেন তৃতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে, এ স্তরে নারীর সংখ্যা ২ লাখ ৪৮ হাজার ৭৮০ জন। চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে নারীদের সংখ্যা ৪৯ হাজার ৪৩৪ জন।
প্রশাসনে নারীর অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহম্মদ বলেন, ‘সরকার নারীর ক্ষমতায়ন যাতে নিশ্চিত হয়, কর্মস্থলকে যাতে নারীবান্ধব করা যায়, শিক্ষার ক্ষেত্রে যে সব সুবিধা দিলে নারীরা এগিয়ে আসবে- সবক্ষেত্রেই সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকার এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এসডিজির যে গোলগুলো আছে, এরমধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন এবং বৈষম্য নিরসনের ক্ষেত্রগুলো নির্ধারণ করাসহ সব বিষয় নিয়ে সরকার কাজ করছে। শুধু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নয়, সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগই তাদের অধিক্ষেত্রের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার আগে দেখেছি একজন নারীকে নামে মাত্র একদিনের জন্য সচিব করা হয়। সেই অবস্থা থেকে তো আমরা অনেক দূর এসেছি। প্রশাসনে প্রতিবছরই নারী কর্মকর্তাদের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে।’
বলা হচ্ছে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে নারীরা সেভাবে উঠে আসছেন না- এ বিষয়ে জনপ্রশাসন সচিব বলেন, ‘শুধু সচিব পদ দিয়ে আপনি নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি বিচার করতে পারবেন না। সচিবের ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় দেখা হয়। এটি কেবল ডেন্ডার নয়, এটি কেবল চাকরির লেন্থ নয়। এখানে আমার দক্ষতাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়।’
ফয়েজ আহম্মদ বলেন, ‘আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রীর যে সব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন ভিশন-২০২১, ২০৪১ ও এসডিজি সবগুলোতেই নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি প্রায়োরিটি দেয়া হয়েছে। আমরা দিন দিনই লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।’
বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের এক তথ্যে দেখা গেছে, নারী বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে ২১ শতাংশ, পুলিশ ক্যাডারে ৯ শতাংশ, পররাষ্ট্র ক্যাডারে ২৫ শতাংশ, স্বাস্থ্য ক্যাডারে ১৭ শতাংশ, শিক্ষা ক্যাডারে ২৭ শতাংশ, পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারে ১৩ শতাংশ, কর ক্যাডারে ১১ দশমিক ২ শতাংশ, অডিট ক্যাডারে ২০ শতাংশ, পরিসংখ্যান ক্যাডারে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ।
নারী সচিব রয়েছেন যারা
সর্বশেষ বৃহস্পতিবারের তথ্য অনুযায়ী, প্রশাসনে পাঁচজন সিনিয়র সচিব, সচিব বা সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন। এরা হলেন- সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জুয়েনা আজিজ, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামীমা নার্গিস, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুন নাহার, বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথরিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব রৌনক জাহান এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব উম্মুল হাসনা।