নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চাপে সরকার সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছে। নতুন আইন হচ্ছে জেনে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন বন্ধ করে ঘরে ফিরে গেছে। কিন্তু আন্দোলনের শেষ দিকে সরকারি দলের কর্মীদের হামলা এবং পরবর্তী মামলা ও পুলিশের হয়রানির বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেনি বহু শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার। একই ভাবে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অবস্থাও তাই। সারা দেশে লাখো তরুণের আন্দোলন দমন, মামলা-গ্রেপ্তার ও দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূরণ না করায় ক্ষমতাসীনদের ওপর মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন তাঁরা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিক দলের অনেক নেতাই বলছেন, দুটি আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যতটা না তৎপরতা দেখিয়েছে, তার চেয়ে কয়েক গুণ তৎপরতা দেখিয়েছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যা শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ছিল না।
তবে এখন ভোটের সময় ঘনিয়ে আসায় ক্ষমতাসীন জোটের নেতাদের মনে সংশয় ও শঙ্কা দেখা দিয়েছে—এবারের নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা তাঁদের ভোট দেবেন তো? তাই ১৪-দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের অনেকে শিক্ষার্থীদের মনের এই কষ্ট দ্রুত উপশমের ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ বোধ করছেন। তবে ঠিক কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে বিষয়ে দলটি এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি।
১৪-দলীয় জোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘এ কথা সত্য যে নিরাপদ সড়ক ও সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মনের মধ্যে গভীর ক্ষত নিয়ে ফিরে গেছে। এই ক্ষত আগামী নির্বাচনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। তাই বিষয়টিকে অবহেলা করা যাবে না। এই ক্ষত নিবারণের জন্য সরকার ও ক্ষমতাসীনদের জোট ১৪ দলের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।’ রাশেদ খান মেনন জানান, তিনি সরাসরি দেখা করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জোটপ্রধান শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানাবেন।
অবশ্য আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক নেতা বলেন, সাধারণত আওয়ামী লীগের যাঁরা ভোটার তাঁরা আওয়ামী লীগকেই ভোট দেন। তবে ভাসমান ভোটারদের বিষয়টি তাদের ভাবাচ্ছে। কেননা প্রতিটি আসনে তরুণদের মধ্যে যাঁরা ভাসমান ভোটার বা আওয়ামী লীগের কট্টরপন্থী সমর্থক নন, তাঁদের ভোট নিয়ে শঙ্কাটা বেশি। এসব তরুণের কারণে তাঁদের পরিবারের অন্য সদস্যদের ভোটও আওয়ামী লীগকে হারাতে হতে পারে। ওই নেতা বলেন, প্রতিটি ভোট গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের আগে তরুণদের মনের ক্ষত দূর করা উচিত, অন্যথায় সেটি আওয়ামী লীগ বা ১৪-দলের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে।
গত ২৯ জুলাই শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম বাসের চাপায় পিষ্ট হয়ে মারা যায়। পরদিন থেকে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় কোটা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীরাও। ৬ আগস্ট মন্ত্রিসভায় সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া পাসের আগ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলে। ১০ দিন ধরে চলা এই আন্দোলনে পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হামলায় আহত হয় কয়েক শ শিক্ষার্থী। তবে পুলিশ এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কেউ কেউও গুরুতর আহত হন।
সরকারি দলের এবং তাদের শরিক দলগুলোর একাধিক শীর্ষ নেতার মতে, সরকার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে শুরুতে গুরুত্ব দেয়নি। গুরুত্ব যখন দিয়েছে, তখন তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত অনেকটা বাধ্য হয়ে তড়িঘড়ি আইন পাসের প্রস্তাব করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কোটা আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সরকার বিলম্বে পদক্ষেপ নিয়েছে। দুটি আন্দোলনকেই শুরু থেকে গুরুত্ব দেওয়া হলে পরিস্থিতি এত দূর গড়াত না।
১৩ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে কোটা সংস্কারে গঠিত কমিটির প্রধান ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেছেন, কমিটি কোটা তুলে দিয়ে মেধাকে প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন চলাকালে এবং আন্দোলনের পর ছাত্রদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় অভিযান নিয়েও আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিক ১৪ দলের একাধিক নেতা হতাশা প্রকাশ করেছেন। সর্বশেষ গোয়েন্দা পুলিশ কর্তৃক রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১২ শিক্ষার্থীকে আটক করার বিষয়টি নিয়ে তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা মনে করেন, শিক্ষার্থী ও তরুণেরাই ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের পেছনে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিলেন। এবারের নির্বাচনেও জয়-পরাজয় নির্ধারণে এঁদের ভোট বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।
ভোটার তালিকায় কী পরিমাণ শিক্ষার্থী ও তরুণ ভোটার রয়েছেন, সেটা নিয়েও ভাবতে শুরু করেছেন আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটের শীর্ষ নেতারা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০-এর মধ্যে। আর ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী ভোটারের সংখ্যা ১৫ শতাংশের মতো। অর্থাৎ প্রতিটি আসনে গড়ে এই বয়সী ভোটারের সংখ্যা ৫০ হাজারের কম-বেশি। এঁদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, এবারের হালনাগাদ শেষে নতুন ভোটারের সংখ্যা ৪৩ লাখের বেশি। সব মিলিয়ে এবার ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪১ লাখের বেশি। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার মতে, ৫০ হাজারের কম-বেশি ভোটার যেকোনো আসনের জয়-পরাজয় নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, বিষয়টি তাঁরা দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে জানাবেন।