কিছুদিন আগেও দেয়ালগুলো ছিল বার্ধক্যের সঙ্গে লড়তে থাকা আশাহীন মানুষের মতো। জীর্ণ শীর্ণ, বিবর্ণ, মলিন ও উদাসীন! একটুখানি মমতার স্পর্শের অভাবে তারা যেন নির্বিকার জীবন-যাপন করছিল। সেই মলিন দেয়ালগুলো রঙের ছোঁয়ায় যেন যৌবন ফিরে পেয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকার দেয়ালের রূপ। দেশের আনাচে কানাচে এতদিন প্রাণহীন থাকা দেয়ালগুলো নীরবতা ভেঙে উচ্চারণ করতে লাগলো ছাত্র সমাজের অব্যক্ত কথামালা। মানুষের না বলা কথাগুলো ছাত্র-ছাত্রীরা এঁকে দিতে লাগলো দেয়ালের সমগ্র শরীরজুড়ে। এতে সীমানাপ্রাচীরগুলো হয়ে ওঠে প্রতিবাদ, দেশপ্রেম, সাম্য, বিপ্লব ও ভ্রাতৃত্ববোধের সুন্দরতম প্রতীক।
একইভাবে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার নাটমুড়া পুকুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের (নাপুউবি) সীমানাপ্রাচীর জুড়ে শোভা পাচ্ছে বহুমাত্রিক দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগ্রামী প্রত্যয়ে বলীয়ান শহীদদের স্বপ্নকে হৃদয়ের সব কল্পনা দিয়ে রংতুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন বিদ্যালয়টির বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা।
অনেকটা উৎসবের আমেজ বিরাজ করছিল বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। কেউ দেয়াল ঘষে পরিষ্কার করছেন, কেউবা সেখানে রঙের প্রলেপ দিচ্ছেন। কেউবা প্রলেপ দেওয়া জায়গায় আঁকছেন লাল-সবুজের পতাকা বা বাংলাদেশের মানচিত্র। কেউবা আবার স্লোগান লেখায় ব্যস্ত। এভাবে প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের রংতুলির সুনিপুণ আঁচড়ে বিদ্যালয়ের সীমানাপ্রাচীর ফুটে উঠেছে নানা ধরনের চিত্রকর্ম ও পঙক্তিতে।
এসব গ্রফিতিতে ছাত্র অভ্যুত্থানে শহীদদের প্রতিকৃতি ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধার পাশাপাশি উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা, উচ্চারিত হয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রে সমতার বাণী, স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, স্বৈরতন্ত্রের অবসান কথা, মুক্তবুদ্ধি চর্চার স্বরূপ, শৃঙ্খল-মুক্তির বার্তা, বাক্-স্বাধীনতার কথা, মাথা নত না করার প্রত্যয়, বিশ্বাস ও দ্রোহের কথা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বুলি, সম-অধিকার থেকে শুরু করে সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর প্রতিরোধের অগ্নিময় উক্তি ও সাহসী চিত্রায়ণ।
বিবর্ণ অতীত সাদা রঙে মুছে তারা যেন আগামী প্রজন্মের জন্য স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হাজির করতে বদ্ধপরিকর। যে শিক্ষার্থী কখনো রংতুলি হাতে নেয়নি; সেও যেন আঁকতে চাইছে তার ভাবনার কথা, সাহসের কথা কিংবা তার স্বপ্নের কথা।
বিদ্যালয়-প্রাঙ্গণে অন্যান্যদের মতো হাজির হয়েছিলেন ২০১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী মোঃ ইমতিয়াজ উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘ছাত্র-সমাজের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের অর্ন্তভুক্তিতে এ আন্দোলন গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এবং ভবিষ্যতে কেমন বাংলাদেশ হবে তা বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আমাদের এই উদ্যোগ। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে।’
অন্য অনেকের মতো রংতুলি হাতে আঁকছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ফাতেমা জান্নাত তানিশা। অনুভূতি ব্যক্তকালে তিনি বলেন, ‘এটা মূলত প্রতীকী প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের মাধ্যমে আমরা মূলত ‘জিরো ডিসক্রিমিনেশন (সম্পূর্ণ বৈষম্যহীন)’ নীতির বাস্তবায়ন চাই। অনেক সময় নিজেরা যা মুখ ফুটে বলতে পারি না, তা দেয়ালের মুখ দিয়ে বলাচ্ছি; যা লিখতে পারি না, তা রংতুলিতে ফুটিয়ে তুলছি। যে কেউ দেয়ালের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই যেন সাম্য, সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িকতার এক সুন্দর সম্মিলন দেখতে পায়’।
সবচেয়ে ব্যস্ত পথচারীটাও একটু ঝিরিয়ে এক পলকে অবলোকন করছেন এসব সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ। যেন কৌতূহলী নয়নে দেখছেন ছাত্র-সমাজের আগামীর সোনার বাংলাকে। বিদ্যালয়টির অবস্থান সড়কের পাশে হওয়ার কারণে এই উদ্যোগটি শুধু বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরকে নয়, বরং পথচারীদের মনকেও নতুন করে রাঙিয়েছে। প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের এই সৃজনশীল প্রয়াস ভবিষ্যতের বৈষম্যহীন সাম্যের বাংলাদেশ গড়ার এক শুদ্ধতম প্রতিচ্ছবি।