প্রতিদিন কুরআন পাঠের গুরুত্ব

লেখক:
প্রকাশ: ৫ years ago

সিবগাতুর রহমান

প্রতিদিন কুরআন পাঠের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই বিষয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমেই আমাদের কে জানতে হবে কুরআন কি? কুরআন আসমানি গ্রন্থ। যা হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর সুদীর্ঘ ২৩ বছরে জিবরিল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে নাজিল হয়েছিল।

কুরআনের গুরুত্ব তুলে ধরে মহান আল্লাহ তাআলা হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে বলেন-

إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلًا ثَقِيلًا

আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী।‘ (সুরা মুযাম্মিল : আয়াত ৫)

এ আয়াতে ‘গুরুত্বপূর্ণ বাণী’ বলতে মহান আল্লাহ বুঝাতে চাচ্ছেন- ইহা (কুরআন) এতই গুরুত্ববহ যে দুনিয়ার কোনো শক্তিই এর একটি শব্দ বা অক্ষরের সংশোধন, পরিবর্তন বা স্থানান্তরের ক্ষমতা রাখে না। আর তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

কুরআনের এই সুন্দরতম শব্দমালা বিগত ১৫শ’ বছর ধরে  সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় আছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। কুরআনের এ নিশ্চয়তার কথা মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনেই ঘোষনা দিয়েছেন এভাবে-

إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ

নিশ্চয়ই আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।‘ (সুরা হিজর : আয়াত ৯)

বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক বসওয়ার্থ স্মিথ তার লেখা ‘মুহাম্মদ ও মুহাম্মদিজম’ বইতে লিখেছেন-

‘কুরআনে সম্ভাব্য সব ধরনের সন্দেহের উর্ধ্বে উঠে কোনো প্রকার সংযোজন ও বিয়োজন ছাড়াই মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সেই হুবহু শব্দসমূহ বর্ণিত আছে।

মহান আল্লাহ তাআলা নিজেই সুন্দরতম পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের পরিচয়  আমাদের সামনে এভাবে তুলে ধরেছেন-

– ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ

এটি ঐ কিতাবযাতে কোনো সন্দেহ নেই। পরহেযগারদের জন্য পথ প্রদর্শনকারী।‘ (সুরা বাকারাহ : আয়াত ২)

– كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُوْلُوا الْأَلْبَابِ

‘এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি বরকত হিসেবে অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসূহ লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে।’ (সুরা সাদ : আয়াত ২৯)

মানুষই হলো কুরআনের আলোচ্য বিষয়। আর মানুষ সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্যও বর্ণিত হয়েছে এ কিতাবে। আল্লাহ তাআলা মানবগোষ্ঠীকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য উল্লেখ করে বলেন-

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

‘আর আমি মানুষ ও জিন জাতি আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা যারিয়াত : আয়াত ৫৬)

এ আয়াতে মানব সৃষ্টির চুড়ান্ত উদ্দ্যেশ্য হিসেবে আল্লাহর ইবাদত করার বিষয়টি উঠে এসেছে। আর এ ইবাদত করার কথার অর্থ শুধু আল্লাহর কাছে সেজদা করাই নয় বরং পবিত্র কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী তার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর গুনাবলী ও নিজেদের মাঝে অর্জন করা। যাতে মানুষ এ দুনিয়াতে আল্লাহর প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এর জন্য একমাত্র প্রয়োজন ও উপায় হলো-

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সঠিক শিক্ষাগ্রহণ, অনুশীলন ও তা হৃদয়ঙ্গম করে এর পবিত্র শিক্ষামালার যথাযথ ও সঠিক বাস্তবায়ন করা। কেননা এ কুরআনের শিক্ষার মাঝেই মানবজীবনের সব স্বার্থ ও যাবতীয় কর্মকান্ড এবং দুনিয়া ও পরকালের ছোট থেকে বড় সব সমস্যার সমাধান বিদ্যমান। তাইতো কুরআনকে বলা হয় মানুষের পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা।

আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন-

– أَقِمِ الصَّلاَةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَى غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآنَ الْفَجْرِ إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًا

সূর্য ঢলে পড়ার সময় থেকে রাত্রির অন্ধকার পর্যন্ত নামায কায়েম করুন এবং ফজরের কোরআন পাঠও। নিশ্চয় ফজরের কোরআন পাঠ মুখোমুখি হয়।‘ (সুরা বনি-ইসরাঈল : আয়াত ৭৮)

– اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاء وَالْمُنكَرِ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ

আপনি আপনার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব পাঠ করুন এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা করুন। নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন তোমরা যা কর।’ (সুরা আনকাবুত : আয়াত ৪৫)

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন-

لَوْ أَنزَلْنَا هَذَا الْقُرْآنَ عَلَى جَبَلٍ لَّرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنْ خَشْيَةِ اللَّهِ وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ

যদি আমি এ কুরআন পাহাড়ের উপর অবতীর্ণ করতাম, তবে তুমি দেখতে যে, পাহাড় বিনীত হয়ে আল্লাহ তাআলার ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে গেছে। আমি এসব দৃষ্টান্ত মানুষের জন্যে বর্ণনা করি, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।’ (সুরা হাশর : আয়াত ২১)

সে কারণেই সব সময় আল্লাহকে স্মরণ করা, কুরআন অধ্যয়ন করা এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা করা- এ সব ইবাদতের উদ্দেশ্যও একই। যাতে মহান আল্লাহ তাআলা সান্নিধ্য পাওয়া যায়।

আল্লাহ তাআলার আদেশ পালন করা আমাদের প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরজ। আর উপরোক্ত আয়াতগুলোতে নামাজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আমাদের কুরআন পড়ার আদেশও করা হয়েছে। কুরআন বুঝে পড়া বা অধ্যয়ন করা আমাদের জন্য এক অসীম নেয়ামত। কুরআন তেলাওয়াত ও অধ্যয়নের মাধ্যমে এ নিয়ামতের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার এক বর্ণনায় তা উঠে এসেছে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী সম্পর্কে হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে জানতে চাইলে, তিনি বলেছিলেন- ‘তোমরা কি কুরআন পড়নি? পুরো কুরআনই হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনী।’

পবিত্র কুরআনের সব শিক্ষামালা আগের সব নবি ও রাসুলগণের শিক্ষার নির্যাস। তাইতো আল্লাহ তাআলা বলেন-

إِنَّ هَذَا لَفِي الصُّحُفِ الْأُولَى – صُحُفِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى

এটা লিখিত রয়েছে আগের (আসমানি) কিতাবসমূহেইবরাহিম ও মুসার কিতাবসমূহে।‘ (সুরা আলা : আয়াত ১৮-১৯)

সুতরাং কুরআনের শিক্ষা লাভে প্রতিদিন কুরআন অধ্যয়ন জরুরি। আর কুরআন অধ্যয়নের ও তেলাওয়াতের সময় এর আদব ও গুরুত্ব রক্ষায়ও কুরআনের বাণী মেনে চলা আবশ্যক। যেখানে কুরআনের আলোচনা হয় কিংবা কুরআন তেলাওয়াত হয় সেখানে ভদ্রভাবে অবস্থান করা এবং আলোচনা শোনা জরুরি। আর তাতে বান্দার ওপর রহমত নাজিল হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُواْ لَهُ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

‘আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তাতে কান লাগিয়ে রাখ এবং নিশ্চু থাক যাতে তোমাদের উপর রহমত নাজিল হয়।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ২০৪)

কুরআনের মর্যাদা ও সম্মানের কারণেই এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা আমাদের বিভিন্নভাবে সতর্ক করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

إِنَّهُ لَقُرْآنٌ كَرِيمٌ – فِي كِتَابٍ مَّكْنُونٍ – لَّا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ – تَنزِيلٌ مِّن رَّبِّ الْعَالَمِينَ – أَفَبِهَذَا الْحَدِيثِ أَنتُم مُّدْهِنُونَ – وَتَجْعَلُونَ رِزْقَكُمْ أَنَّكُمْ تُكَذِّبُونَ

‘ নিশ্চয় এটা সম্মানিত কোরআন, আছে এক গোপন কিতাবে, যারা পাক-পবিত্র, তারা ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করবে না। এটা বিশ্ব-পালনক র্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। তবুও কি তোমরা এই বাণীর প্রতি শৈথিল্য পদর্শন করবে? এবং একে মিথ্যা বলাকেই তোমরা তোমাদের ভূমিকায় পরিণত করবে? (সুরা ওয়াক্বিয়া ৫৬: আয়াত ৭৭-৮২)

অতপর মহান আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে কুরআন তেলাওয়াতের রীতি পদ্ধতি অনুসরণে নির্দেশ ও উপদেশ দিয়ে বলেন-

أَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا – إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلًا ثَقِيلًا – إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْءًا وَأَقْوَمُ قِيلًا – إِنَّ لَكَ فِي اَلنَّهَارِ سَبْحًا طَوِيلًا – وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلًا

অথবা তদপেক্ষা বেশি এবং কুরআন তেলাওয়াত করুন সুবিন্যস্ত ভাবে ও স্পষ্টভাবে। আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী। নিশ্চয় ইবাদতের জন্যে রাত্রিতে উঠা প্রবৃত্তি দলনে সহায়ক এবং (কুরআন) স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল। নিশ্চয় দিনের বেলায় রয়েছে আপনার দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা। আপনি আপনার পালনকর্তার নাম স্মরণ করুন এবং একাগ্রচিত্তে তাতে মগ্ন হোন।’ (সুরা মুযযাম্মিল : আয়াত ৪-৮)

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, মানবজাতির সৃষ্টির উদ্দেশ্য যথাযথ বাস্তবায়নে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সবদিক থেকে পবিত্রতা অর্জনপূর্বক প্রতিদিন আসমানি মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের অনুশীলন, অধ্যয়ন, তেলাওয়াত হৃদয়ে ধারণ করে নিজেদের জীবনে প্রতিফলন করা।

আল্লাহ তআলা মুসলিম উম্মাহকে প্রতিদিন নিয়মিত কুরআন অধ্যয়ন, তেলাওয়াত, অনুশীলন ও যথাযথ মূল্যয়ন করার তাওফিক দান করুন। কুরআনের সমাজ বিনির্মাণে তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : সহকারী ব্যবস্থাপক, সিএস প্রশাসন (ক্যান্টিন ও ক্যাটারিং), প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।