পৃথিবীর প্রথম জমিন “কাবা” সম্পর্কে কিছু তথ্য।

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

পৃথিবীর প্রথম জমিন কাবা সম্পর্কে কিছু তথ্য

লেখকঃ রুবেল মাহমুদ।।

ইসলামী জ্ঞানের তথ্যমতে মাটিতে রূপান্তর হওয়ার আগে কাবা সাদা ফেনা আকারে ছিল। সে সময় পৃথিবীতে পানি ছাড়া কিছু ছিল না। আল্লাহর আরশ ছিল পানির ওপর। হাদিসের ভাষ্য মতে,কাবার নিচের অংশটুকু পৃথিবীর প্রথম জমিন। বিশাল সাগরের মাঝে এর সৃষ্টি। ধীরে ধীরে এর চারপাশ ভরাট হতে থাকে। সৃষ্টি হয় একটি বিশাল মহাদেশের। এক মহাদেশ থেকেই সৃষ্টি হয় অন্য সব মহাদেশ। মাটি বিছানোর পর জমিন নড়তে থাকে। হেলতে থাকে। এর জন্য মহান আল্লাহ পাহাড় সৃষ্টি করেন। ইরশাদ হয়েছে,‘তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছেন,যাতে পৃথিবী তোমাদের নিয়ে আন্দোলিত না হয় (হেলে না যায়)।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১৫) উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালক ড. খালিদ বাবতিনের গবেষণায় দেখা গেছে,সৌদি আরবে অবস্থিত পবিত্র কাবাই পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। (আল আরাবিয়া : ২৩ জুলাই,২০১২)

দুনিয়াজুড়ে মুসলমানদের এই কিবলা তথা কাবা শরিফ সম্পর্কে নানা বিষয় জানতে আমরা সবসময়েই আগ্রহী হই- তবে এর সবটা হয়তো জানা হয় না। এই সুযোগে কাবা সম্পর্কিত কিছু আশ্চর্যজনক তথ্য জেনে নেয়া যাক। অনেকেই হয়তো এ বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত নন। আসুন,বিষয়গুলো জেনে নেওয়া যাক-

ইসলামের দৃষ্টিতে কাবা শরিফের মর্যাদা ও মাহাত্ম্যঃ

কাবার ভিত্তিপ্রস্তর হয়েছে শিরকমুক্ত নির্ভেজাল একত্ববাদের ওপর। আল্লাহ বলেন, স্মরণ করুন সে সময়কে যখন আমি ইব্রাহিমকে বাইতুল্লাহর স্থান নির্ধারণ করে বলেছিলাম যে আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না। (সুরা হজ, ২৬) এখলাস ও একনিষ্ঠতা এ নির্মাণের অন্যতম উপকরণ ছিল। আল্লাহ বলেন,স্মরণ করো,যখন ইব্রাহিম ও ইসমাইল কাবাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল। তারা দোয়া করেছিল : হে আমাদের রব! (এ কাজ) আপনি আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। (সুরা বাকারা,১২৭) কাবা শরিফ পৃথিবীর পবিত্রতম স্থান। আর অপবিত্র কারো সেখানে প্রবেশ করার অধিকার নেই। আল্লাহ বলেন,আমি ইব্রাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম,তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী,অবস্থানকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো। (সুরা বাকারা,১২৫) কাবাগৃহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- তা পৃথিবীর সর্বপ্রথম ও সুপ্রাচীন ঘর। কোরআনের ভাষায়,নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে,সেটাই হচ্ছে এ ঘর,যা মক্কায় অবস্থিত। (সুরা আলে ইমরান, ৯৬) কাবা শরিফ সমগ্র বিশ্বের স্তম্ভস্বরূপ,বিশ্বের ব্যবস্থাপনা ও বাইতুল্লাহর মধ্যে একটি নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,আল্লাহ সম্মানিত গৃহ কাবাকে মানুষের স্থিতিশীলতা ও স্থায়িত্বের কারণ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। (সুরা মায়েদা,৯৭)

কাবা শরিফের অবকাঠামো ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ

সৌদি গেজেট মতে,কাবাগৃহের উচ্চতা পূর্ব দিক থেকে ১৪ মিটার। (অন্য একটি সূত্র মতে ১২.৮৪ মিটার)। পশ্চিম দিক থেকে ১২.১১ মিটার। উত্তর দিক থেকে ১১.২৮ মিটার। দক্ষিণ দিক থেকেও ১২.১১ মিটার। (সূত্র : সৌদি গেজেট, ৩ জানুয়ারি, ২০১০ ইং)
ভূমি থেকে কাবার দরজার উচ্চতা ২.৫ মিটার। দরজার দৈর্ঘ্য ৩.০৬ ও প্রস্থ ১.৬৮ মিটার। বর্তমান দরজা বাদশা খালেদের উপহার,যা নির্মাণে প্রায় ২৮০ কিলোগ্রাম স্বর্ণ ব্যবহার করা হয়েছে। এর সিলিংকে তিনটি কাঠের পিলার ধরে রেখেছে। প্রতিটি পিলারের ব্যাস ৪৪ সে.মি.। কাবা শরিফের ভেতরের দেয়ালগুলো সবুজ ভেলভেটের পর্দা দিয়ে আবৃত। এই পর্দাগুলো প্রতি তিন বছর অন্তর অন্তর পরিবর্তন করা হয়। এর ছাদে ১২৭ সে.মি. লম্বা ও ১০৪ সে.মি. প্রস্থের একটি ভেন্টিলেটর রয়েছে,যা দিয়ে ভেতরে সূর্যের আলো প্রবেশ করে। এটি একটি কাচ দিয়ে ঢাকা থাকে। প্রতিবছর দুবার কাবা শরিফের ভেতরটা ধৌত করার সময় এ কাচ খোলা হয়। কাবার প্রথম ছাদ নির্মাতা- কুসাই,অতঃপর কোরাইশ। প্রথম গিলাফ পরিয়েছেন- তুব্বা আবুল আসাদ। প্রথম গোসল দিয়েছেন- মুহাম্মদ (সা.),মক্কা বিজয়ের দিন। প্রথম আজান দিয়েছেন- বেলাল বিন রাবাহ। প্রথম মিনজানিক দিয়ে হামলা করেছেন হুসাইন,ইয়াজিদের নির্দেশে।

১) কাবা শরিফের সংস্কার:

পবিত্র কাবা শরিফ বেশ কয়েকবার প্রাকৃতিক বিপর্যয় বন্যা এবং আক্রমণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতএব কারণে পবিত্র কাবা বেশ কয়েকবার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তা পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে।

সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য মতে,কাবাকে এ পর্যন্ত ১২ বার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। বিভিন্ন বিপর্যয়ের হাত থেকে সংরক্ষণ করতে কাবা শরিফকে সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে আধুনিক ও শক্তিশালী প্রযুক্তির প্রয়োগে সংস্কার করা হয়। কাবা পুনঃসংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৯৬ সালে হাতিমে কাবাও পুনঃনির্মাণ করা হয়।

পবিত্র কাবা শরিফ নির্মাণ-পুনঃনির্মাণে বিভিন্ন যুগে হজরত আদম (আ.), হজরত ইব্রাহিম (আ.), হজরত ইসমাইল (আ.) এবং আখেরি নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)ও অংশগ্রহণ করেছিলেন।

২) কাবার গিলাফের রং পরিবর্তন:

যে কাপড় দ্বারা কাবাকে ঢেকে দেয়া হয় তাকে কিসওয়া বলে। ‘কিসওয়া’হলো কালো রংয়ের কাপড়। কিন্তু অনেকেরই জানা নেই যে এ কিসওয়া বা গিলাফ সবসময় কালো ছিল না।

প্রথমদিকে জরহাম গোত্রের শাসনামলে তাদের নিয়মানুযায়ী কিসওয়া দ্বারা কাবা শরিফের আচ্ছাদন সর্বপ্রথম শুরু হয়।

পরবর্তীতে প্রিয়নবী (সা.) ইয়েমেনি সাদা কাপড় দিয়ে পবিত্র কাবাকে ঢেকে দেন। বিভিন্ন খলিফাদের আমলে লাল,সাদা,সবুজ রঙের কিসওয়াও ব্যবহার করা হতো। আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে পবিত্র কাবার কিসওয়া হিসেবে বিভিন্ন রঙের ব্যবহার বন্ধ করে কালো রঙের কিসওয়া ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তখন থেকেই কিসওয়ার জন্য কালো রঙটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

৩) আকৃতি পরিবর্তন:

নবী ইব্রাহিমের (আ.) আমল থেকেই মূলত পবিত্র কাবা শরিফ আয়তক্ষেত্র আকৃতির ছিল। ইসলামের আগমনের পূর্বে কুরাইশরা যখন পবিত্র কাবাকে পুনঃনির্মাণ করে তখন তহবিলের অভাবে পবিত্র কাবা শরিফের পুরো কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি তারা। যে স্থানটি তখন নির্মাণ করতে পারেনি সেই স্থানটিকে বলা হয় ‘হাতিমে কাবা’। এটি কাবারই অংশ। এ কারণে হাতিমে কাবাকে তাওয়াফে অন্তর্ভূক্ত করতে হয়। যা একটি ছোট্ট গোলাকার প্রাচীর দ্বারা চিহ্নিত।

৪) দরজা-জানালা:

মূল কাবা শরিফে দুটি দরজা অন্তর্ভূক্ত ছিল। একটি দরজা ছিল প্রবেশের জন্য অন্যটি বাহির হওয়ার জন্য। এছাড়াও পবিত্র কাবা শরিফের দেয়ালে একটি জানালাও ছিল। বর্তমানে পবিত্র কাবা শরিফে রয়েছে একটি মাত্র দরজা এবং কোনো জানালা নেই,যদিও কাবা শরিফের ছাদে ওঠার জন্য ভিতরে একটি দরজা রয়েছে।

৫) ভেতরে কী আছে?

এই প্রশ্ন অনেকেরই। পবিত্র কাবা শরিফের ভেতরে ভিত্তি মজবুতে তিনটি পিলার রয়েছে;যেগুলোর প্রত্যেকটি লিন্টারের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে। পারফিউম ব্যবহারের জন্য পিলারের মধ্যে একটি ছোট বাক্স আকৃতির টেবিল রয়েছে। তিনটি খুঁটি বা স্তম্ভে ঝুলে আছে বিভিন্ন ডিজাইনের প্রদীপমালা। পবিত্র কোরআনের আয়াতের কারুকার্যখচিত সবুজ কাপড় কাবা শরিফের দেয়ালের ওপরের অংশে জুড়ে রয়েছে।

৬) হাজরে আসওয়াদ:

পবিত্র কাবা শরিফের এক কোণে সংযুক্ত ‘হাজরে আসওয়াদ’ কালো পাথরটি আগে আকারে বড় ছিল। বর্তমানে এ পাথরটি ভেঙে ৮ টুকরায় বিভিন্ন সাইজে বিভক্ত। যা একটি সিলভার রংয়ের ফ্রেমে একত্র করে কাবা শরিফের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে লাগানো।

পাথরটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা বন্যাসহ অনেকবার চুরি ও জালিয়াতির চেষ্টার কারণে অনাকাঙ্খিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। হাজরে আসওয়াদের প্রথম সিলভার ফ্রেমটি তৈরি করেছিলেন আবদুল্লাহ বিন জুবাইর।

৭)চাবির জিম্মাদার:

প্রাক ইসলামি যুগ থেকে এখন পর্যন্ত কাবা শরিফের চাবি একটি পরিবারের কাছেই রয়েছে।

সম্মানিত এই পরিবারটি হলো বনু তালহা গোত্র। এ গোত্র গত ১৫শ শতাব্দী ধরে এ দায়িত্ব পালন করছে। এটি ওই পরিবারের জ্যৈষ্ঠ সদস্যরা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হন।

৮) বার্ষিক পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম:

বছরে দুই বার এর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করা হয়। প্রথমবার করা হয় শাবান মাসে আর দ্বিতীয় বার করা হয় জিলকদ মাসে। এ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম বনু তালহা তথা আলশিবি পরিবারের লোকেরাই করে থাকেন।

পবিত্র জমজমের পানি,তায়েফ গোলাপ জল এবং বহু মূল্যবান ‘ঊড’ তৈল দিয়ে একটি পরিষ্কার মিশ্রণ তৈরি করে তা দিয়েই পবিত্র কাবা শরিফ পরিষ্কার করা হয়। পবিত্র নগরী মক্কার গভর্নর এ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরকে আমন্ত্রণ জানান।

৯)বাব আল তাওবাঃ

কাবা ঘরের ছাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় ব্যবহৃত হয় একটি স্বর্ণনির্মিত দরজা রয়েছে পাশের দেয়ালে যেটাকে ‘বাব আল তাওবা’ বলে ডাকা হয়।

১০) দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত:

একটা সময়ে পবিত্র কাবা শরিফের দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এ পবিত্র ঘরে প্রবেশ করে ইবাদাত-বন্দেগিও করতো। হজের সময় তীর্থযাত্রীরা ইচ্ছা করলে এতে প্রবেশ করতে পারতো।

কিন্তু হাজিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ঘরের নিরাপত্তার জন্যই এখন কেউ ইচ্ছা করলেও অভ্যন্তরে যেতে পারে না। এটা এখন মাঝে মাঝে বিশেষ বিশেষ মেহমানদের জন্য খোলা হয়।

১১)তাওয়াফ:
পবিত্র কাবা শরিফ সম্পর্কে অবিশ্বাস্য হলেও চিরন্তন সত্য যে,এর চারদিকে ঘোরা অর্থাৎ তাওয়াফ কখনো বন্ধ হয় না।

তবে হ্যাঁ,নামাজের সময় যখন মুয়াজ্জিন জামাতের জন্য ইক্বামাত দেন ঠিক নামাজের সময় তাওয়াফকালীন অবস্থায় যে যেখানে থাকে সেখানে দাঁড়িয়েই নামাজে অংশগ্রহণ করে। নামাজের সালাম ফিরানোর সঙ্গে সঙ্গে আবার তাওয়াফ শুরু হয়ে যায়।

শুধু তাই নয়,যখন বন্যার কারণে পানিতে তাওয়াফ চত্ত্বর তলিয়ে গিয়েছিল তখনো মানুষ সাঁতার কেটে পবিত্র কাবা শরিফ তাওয়াফ করতো।