#

৪০ দিন বয়সী মৃত সন্তানের অসাড় দেহটি বুকে জড়িয়ে ধরে আছেন এক নারী। বারবার তার মুখে চুমু খাচ্ছেন আর বিলাপ করে কাঁদছেন।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে প্রাণভয়ে নৌকায় করে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার পথে নৌকাডুবিতে সন্তানের মৃত্যু হয়।

হৃদয়বিদারক এই মুহূর্তটির ছবি তুলছিলেন মোহাম্মদ পনির হোসেন। তিনি তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা করছিলেন।

বলছিলেন, ঐদিন সাথে আরেক ফটোগ্রাফারকে নিয়ে শাহপরীর দ্বিপে ছবি তুলতে গিয়েছিলেন।

তাদের সিএনজি চালক খবর দিলো একটা নৌকাডুবি হয়েছে। কয়েক কিলোমিটার হেটে সেখানে পৌঁছান।

পনির হোসেন বলছেন, “ছবিগুলো যখন তুলি তখন আমি আমার আবেগ নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলাম। কিন্তু হোটেলে ফিরে এডিট করতে গিয়ে ল্যাপটপে যখন ছবিগুলোকে দেখলাম তখন আর আমার পক্ষে আবেগ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।”

“মানুষের কষ্ট কতরকম এটা রোহিঙ্গা ইস্যু যদি কাভার না করতাম তাহলে সম্ভবত আমি বিষয়টা বুঝতাম না।”

এই ছবিটি সহ আরো দুটি ছবির জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

অন্য দুটির একটিতে দেখা যাচ্ছে গত বছরের আগস্টের শেষের দিকে সীমান্তের কাছে বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায় একদল রোহিঙ্গা তুমুল বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন।

সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি তাদের সেখানে আটকে রেখেছে।

অন্য ছবিটিতে রয়েছে ভেলায় চড়ে নদীপথে বাংলাদেশের আসা একদল রোহিঙ্গা।

রোহিঙ্গাদের এমন চরম দুর্ভোগ আর হৃদয়বিদারক কিছু ছবি তোলার জন্য আন্তর্জাতিক নিউজ এজেন্সি রয়টার্স এবারের পুলিৎজার পুরস্কারটি পেয়েছে।

পুলিৎজারকে বলা হয় সাংবাদিকদের অস্কার পুরস্কার।

রয়টার্সের মোট সাতজন আলোকিত্রি রোহিঙ্গাদের নানা মুহূর্তের ছবির জন্য দলগতভাবে এই পুরস্কার পান।

এ মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের মোঃ পনির হোসেন।

এই প্রথম কোনও বাংলাদেশি হিসেবে তিনি সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের সবচাইতে সম্মানজনক পুলিৎজার পুরস্কার পেলেন।

২০১০ সাল থেকে পনির হোসেন ছবি তুলতেন সখের বসে। সেই শখই একদিন তার পেশা হয়ে দাঁড়ালো।

শুরুতে তিনি ফ্রিল্যান্সার হিসেব কাজ করতেন। ২০১৫ সালে তিনি রয়টার্সে যোগদান করেন।

তিনি বলেন, “মানুষ যখন কোন দুর্দশায় পরে বা কোন সংকট তৈরি হয় তখনই আমাদের মতো ফটোসাংবাদিকদের দক্ষতা দেখানোর সুযোগ তৈরি হয়। যেমন রোগী না থাকলে ডাক্তারের দক্ষতা দেখানোর সুযোগ নেই, আমাদের জন্যেও বিষয়টা একই রকম।”

তিনি বলছিলেন, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দেশে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বাঁচার জন্য তারা রোদে পুড়ে, পানিতে ভিজে লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছে এসেছেন।

তারা জানেন না সামনে কি আছে, তারা কোথায় যাচ্ছেন, কি খাবেন বা কোথায় থাকবেন।

কতটা কষ্টে পড়লে মানুষ এমন অনিশ্চিত যাত্রার উদ্দেশ্য রওয়ানা দেন সেই বিষয়টি তাকে খুব নাড়া দিয়েছে, বলছিলেন পনির হোসেন।

তিনি বলছেন, “এই ছবিগুলো তুলতে গিয়ে আমি নিজে যতই কাদার মধ্যে হাটি, রোদে পুড়ি বা পানিতে সাতার কাটি, দিন শেষে যখন একটা ভালো ছবি হয় তখন আর সেই ক্লান্তির কথা মনে থাকে না।”

পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী একটি মানবিক ছবি সম্পর্কে পনির বলেন, ‘ছবিটিতে দেখা গেছে, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে একটি নৌকা ডুবে যাওয়ার পর এক রোহিঙ্গা মা তার ৪০ দিনের শিশুর ঠোঁটে চুমু খেয়ে কাঁদছেন।’

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি আসলে প্রকাশ করা সম্ভব না, বলছিলেন তিনি।

পনির চট্টগ্রামের খাজা আজমেরি হাইস্কুল থেকে এসএসসি সম্পন্ন করে এইচএসসি পড়েছেন ঢাকা সিটি কলেজে। পরে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করে ফিলিপাইনের অ্যাতেনিও ডি ম্যানিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিজ্যুয়াল জার্নালিজমের ওপর উচ্চশিক্ষা নেন।

উত্তর দিন

Please enter your comment!
এখানে আপনার নাম লিখুন