লাবনী আক্তারের (৩০) সঙ্গে দেড় বছর আগে ফেসবুকে পরিচয় হয় পুলিশ কনস্টেবল অভিজিৎ বিশ্বাসের (২৩)। অভিজিৎ সনাতন ধর্মাবলম্বী হলেও পরিচয়ের সময় ফেসবুকে তিনি সোহাগ নামে আইডি ব্যবহার করেন। পরিচয়ের সূত্র ধরে প্রেম, এরপর সম্পর্ক গড়ায় বিয়ে পর্যন্ত। তবে বিয়ের সময় কাবিনে নাম লেখার সময় অভিজিৎ বিশ্বাসের ধর্ম পরিচয় জানতে পারেন লাবনী। এরপর বিয়েতে অস্বীকৃতি জানান লাবনী। পরে অনেক বুঝিয়ে লাবনীকে বিয়েতে রাজি করান অভিজিৎ। তবে বিয়ের সময় লাবনীর পরিবারের কেউ উপস্থিত ছিল না।
লাবনীর এর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল। কয়েক বছর আগে সেই স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়। ওই পক্ষে তার ১১ বছরের একটি কন্যা সন্তানও রয়েছে। গতকাল শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে মাদারটেকের পাবনা গলির একটি বাসা থেকে লাবনীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ, সে সময় তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। অভিজিতের সঙ্গে বিয়ের আগে থেকেই (৫ বছর ধরে) ওই বাসায় বসবাস করে আসছেন লাবনী।
লাবনীর পরিবারের সদস্য ও বাড়িওয়ালার উপস্থিতে পুলিশ দরজা ভেঙে মরদেহ উদ্ধার করে। মরদেহ উদ্ধারের পর প্রাথমিকভাবে এটিকে আত্মহত্যা বলে জানায় পুলিশ।
তবে ঘটনার পর থেকে লাবনীর নিকটাত্মীয়রা এটিকে হত্যা বলে দাবি করছেন। তারা হত্যা মামলা করতে গেলেও সবুজবাগ থানা পুলিশ মামলাটি গ্রহণ করেনি বলেও দাবি তাদের।
খুলনার সদর উপজেলার দক্ষিণ টুটপাড়া গ্রামের মৃত আবুল বাশারের মেয়ে লাবনী আক্তার। ছোট বেলায় বাবা হারানো লাবনীর কোনো আপন ভাই-বোন নেই। ১০ মাস আগে মাও মারা যান।
লাবনীর খালাতো ভাই নূর হোসেন নয়ন অভিযোগ করে বলেন, পুলিশসহ তিনি নিজে দরজা ভেঙে রুমের ভেতরে প্রবেশ করেন। রুমে প্রবেশ করেই দেখতে পান সিলিং ফ্যানের সঙ্গে সবুজ রঙের ওড়না পেঁচানো অবস্থায় লাবনী ঝুলে আছেন। তার এক পা ছিল খাটের ওপরে, আরেক পা বসা অবস্থায় ছিল চেয়ারের ওপর। এমন দৃশ্য দেখে আমার মনে হয়নি লাবনী আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু পুলিশ শুরু থেকেই বলছে আত্মহত্যা।
তিনি বলেন, তার বোনকে নির্যাতন করা হতো। তাকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হতে পারে। লাবনী আক্তারের আগে একটি বিয়ে হয়। সেই ঘরে এক কন্যা সন্তান রয়েছে। ৫/৬ বছর আগে ওই স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয় লাবনীর। এরপর ফেসবুকে অভিজিতের সঙ্গে পরিচয় হয়। অভিজিৎ নিজের নাম এবং ধর্ম পোপন করে সোহাগ নামে পরিচয় দিয়ে লাবনীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পরে অবশ্য লাবনীর পূর্বের বিয়ের বিষয়টিও জেনে যান অভিজিৎ। এরপর পরস্পর সব জেনেশুনেই তারা বিয়ে করেন।
আগের ঘরের সন্তানকে নিয়েই লাবনী থাকতেন জানিয়ে নূর হোসেন নয়ন বলেন, সম্প্রতি লাবনী অন্তঃসত্ত্বা হলে বাচ্চা নষ্ট করার জন্য তাকে চাপ দিতেন, নির্যাতন করতেন অভিজিৎ। কিন্তু লাবনী অনড় ছিলেন। তাছাড়া লাবনীর মেয়েকে নানাভাবে কটু কথাও বলতেন অভিজিৎ। গত শুক্রবার সারারাত লাবনীকে শারীরিক নির্যাতন করে ভোরে অভিজিৎ চলে যান বলেও অভিযোগ করেন নয়ন।
তিনি বলেন, থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ বলে এটি আত্মহত্যা। আত্মহত্যায় আবার হত্যা মামলা কীভাবে হয়?- এই কথা বলে গতকাল একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছে পুলিশ। তবে আজ (রোববার) সবুজবাগ থানা থেকে আমিনুল নামের এক পুলিশ কর্মকর্তা ফোন করে থানায় যেতে বলেছেন। ওসির সঙ্গে কথা হয়েছে জানিয়ে তিনি মামলা নেবেন বলে জানান।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে লাবনীর মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষ হয় আজ বিকেলে। এরপর দাফনের জন্য গ্রামের বাড়ি খুলনায় মরদেহ পাঠানো হয়।
ময়নাতদন্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে লাবনীর খালাতো ভাই বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে তিনি মর্গের ডোম ও মর্গে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, লাবনীর যে পা খাটের ওপর ছিল সেই পায়ের গোড়ালিতে দাগ রয়েছে। এছাড়াও হাঁটু ও হাতে নির্যাতনের দাগ রয়েছে।
লাবনী আত্মহত্যা করেননি দাবি করে নয়ন বলেন, তাকে মেরে ফেলেছে। আমার বোনের হত্যার বিচার চাই। তিনি (লাবনীর স্বামী অভিজিৎ) পুলিশের লোক বলে কি আমরা বিচার পাবো না? আমি জানি আইন সবার জন্য সমান। এর সুষ্ঠু তদন্ত যেন হয় এবং বিচার হোক সেটাই চাই।
হত্যা মামলা করবেন কি না জানতে চাইলে লাবনীর খালাত ভাই বলেন, কিছুক্ষণ আগে মরদেহ দাফনের জন্য খুলনায় পাঠানো হয়েছে। দাফনের পর পরিবারের সিদ্ধান্তে থানায় হত্যা মামলা করা হবে।
যে বাসা থেকে লাবনীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে ওই বাড়ির মালিক সুমাইয়া আক্তার বলেন, গত পাঁচ বছর ধরে লাবনী তার বাসায় ভাড়া থাকতেন। প্রথম তিন বছর তৃতীয় তলায় থাকলেও অনেক টাকা বকেয়া হওয়ার কারণে ভাড়া কমাতে পরে পাঁচ তলায় চলে যান। গত শুক্রবার দুপুরে লাবনী ও অভিজিতের মধ্যে ঝগড়ার কথা শুনে পাঁচ তলায় গিয়ে আমি সমাধান করে দিয়ে চলে আসি। এরপর আর তাদের রুমে আমি যাইনি। সকালে পুলিশের সঙ্গে গিয়ে দরজা ভেঙে মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
কনস্টেবল অভিজিৎ বিশ্বাস তার বাসায় কতদিন থেকে যাতায়াত করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই বছর আগে অভিজিৎ তার বাসায় যাতায়াত শুরু করেন। প্রথমে লাবনী অভিজিতকে দেবর পরিচয় দেন এবং তার নাম সাগর বলে জানান। পরে অভিজিৎ জানান তাদের বিয়ে হয়েছে এবং তিনি তার আসল পরিচয় দেন।
এই ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে জানিয়ে সবুজবাগ থানার ওসি-তদন্ত শেখ আমিনুল বাসার বলেন, এটি একটি আত্মহত্যা। কারণ দরজা ভেঙে মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বাদী নিজেই পুলিশের উপস্থিতিতে দরজা ভেঙেছেন। বাকিটা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে জানা যাবে।
মৃতের খালাতো ভাই দাবি করছেন এটি আত্মহত্যা নয় এবং থানা পুলিশ হত্যা মামলা নেয়নি। এ বিষয়ে ওসি শেখ আমিনুল বাসার বলেন, তিনি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন।
লাবনীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেই এজাহার করা হয়েছে জানিয়ে মতিঝিল বিভাগের সবুজবাগ জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) মনতোষ বিশ্বাস বলেন, মরদেহের ময়ানাতদন্ত করা হয়েছে। যদি মেডিকেল রিপোর্টে ভিন্ন কিছু আসে তখন মামলা নেওয়া হবে। মরদেহ উদ্ধারের সময় মৃতের পরিবারের সদস্যরা পুলিশের সঙ্গেই ছিলেন। ওই রুমের দরজা-জানালা সব বন্ধ ছিল। সব বন্ধ রেখে ভেতর থেকে কোনোভাবে বের হয়ে যাবে এমন উপায় ছিল না।
কনস্টেবল অভিজিৎ বিশ্বাস ঢাকায় নেই জানিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, অভিজিতকে গতকালই ডাকা হয়েছে, তিনি এখনও আসেননি। হয়তো মরদেহ নিয়ে ব্যস্ততা থাকার কারণে তিনি আসেননি। তবে আবারও যোগাযোগ করে তাকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।