বর্তমানে শেয়ারবাজারের বেশ পরিচিত নাম মডার্ন সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি)। সফল এ শেয়ার ব্যবসায়ী একজন সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে ব্রোকারেজ হাউসের মালিক। নারীদের মধ্যে তিনিই একমাত্র সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসইর) পরিচালক নির্বাচিত হন।
তবে এ পর্যায়ে আসতে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে (কেমিস্ট্রি) অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করা খুজিস্তাকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চলার পথে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হন। কিন্তু কোনো বাধায় তাকে দমাতে পারেনি। পুরুষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর সাহস নিয়ে এগিয়ে গেছেন সামনে। ফলে পেয়েছেন সফলতাও।
তার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতাই নিজের মুখেই এসব কথা জানিয়েছেন এ শেয়ার ব্যবসায়ী। ব্রোকারেজ হাউস কেনা এবং ডিএসইর পরিচালক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে যেসব বাধার মুখে পড়েছেন অকপটে জানিয়েছেন সেসব কথা।
খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন বলেন, আমিই একমাত্র নারী, নির্বাচনের মাধ্যমে ডিএসইর পর্ষদ সদস্য হয়েছি। পুরাতন যারা ছিল, তাদের কেউ কেউ চিন্তা করেছে একটা মেয়ে কভাবে এতো সাহস পেল। তারা দূর থেকে চাচ্ছিল আমাকে বসিয়ে দিতে। আমাকে ডিমোটিভেট (নিরুৎসাহিত) করার চেষ্টা করতো।
‘আমার নির্বাচন করাটা অনেক কঠিন ছিল। প্রথমে অনেকের আচরণ ছিল একটা মেয়ে কেন এসেছে। আমি দাঁড়িয়েছি বলে যেন তাদের ইজ্জত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাট আমি দমবার পাত্র না। সবসময় ছেলেদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এসেছি। আমার পরিবারও পুরুষ আধিক্য ছিল। সুতরাং পুরুষ আমার জন্য কোনো বিষয় না’- বলেন খুজিস্তা।
তিনি বলেন, পুরুষ দেখে আমি ভয় পেয়ে যাব বা পুরুষের চোখ রাঙানি আমি ভয় পাব, ওই টাইপের কোনো দিন ছিলাম না। আমি সবসময় চ্যালেঞ্জটাকে গ্রহণ করেই এগিয়েছি। আমি কখনও পিছপা হয়নি। আমার সাহস আমাকে এত দূর নিয়ে এসেছে।
শেয়ার ব্যবসায় জড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, মেয়েদের ক্ষেত্রে সংসার ও ক্যারিয়ার একসঙ্গে শুরু করতে হয়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ক্যারিয়ার ও সংসার একসঙ্গে করা অনেক কঠিন। আমার যেহেতু অল্প বয়সে বাচ্চা হয়ে যায়, সে কারণে তখন ক্যারিয়ারটাকে সেক্রিফাইস করি, চাকরি-বাকরি কিছু করিনি। তারপর আমার মনে হয়েছে কিছু একটা করা উচিত, এত পড়ালেখা করেছি। তখন ভাবলাম শেয়ার ব্যবসা এমন একটা জায়গা, যেখানে শুধু বুদ্ধির দরকার হয়, মেধার দরকার হয়। মেধা তো আমার আছে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স করেছি।
শেয়ারবাজারে সময়ের একটা ব্যাপার আছে। সেটা হলো প্রতিদিন আমাকে একটি ফিক্সড টাইমে (নির্ধারিত সময়) থাকতে হয় না, যদি আমি বিনিয়োগকারী হিসেবে থাকি। এগুলো চিন্তা করে প্রথমে অল্পকিছু টাকা নিয়ে বিনিয়োগকারী হিসেবে এখানে আসি। কিছু একটা করলাম আবার টাকাও আয় হলো এবং সময়ের বাধ্যবাধকতা নেই। একই সঙ্গে আমার বাচ্চা দেখতে পারছি, স্বামীকে সামলাতে পারছি। সংসার, রান্না করতে পারছি। সেজন্য ১৯৯৯ সালে বিনিয়োগকারী হিসেবে আসি, শিখতে থাকি। এরপর ২০০৪ সালে ব্রোকারেজ হাউস কিনি। এভাবেই আমার শুরু- যোগ করেন খুজিস্তা।
তিনি বলেন, এখানে (শেয়ারবাজার) সবকিছু নিজে নিজে শিখে নিয়েছি। আমি যেহেতু সাইন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের তাই কমার্সের যেটুকু বাকি ছিল তা বাসায় শিক্ষক রেখে আমি শিখে নিয়েছি। শেয়ারবাজারের যে বিষয়গুলো আমার জন্য মেন্ডেটরি, যেগুলো না জানলে আমি কাজ করতে পারব না, সেগুলো আমার শিক্ষক শিখাতেন। বিভিন্ন হাউসে হাউসে গিয়েও আমি শিখেছি। ইনিশিয়াল পার্ট আমার জন্য অনেক কষ্টকর ছিল, এটা এত সহজ ছিল না।
এখানে (শেয়ারবাজার) প্রথমে যে নারীরা আসে, আপনি দেখবেন তাদের কারও স্বামীর হাউস, কারও ভাইয়ের হাউস, কারও বাবার হাউস। আমির একমাত্র নারী সরাসরি এসেছি। সে কারণে আমার জন্য চ্যালেঞ্জটা অনেক বড় ছিল। আমি পুরুষদের সমকক্ষভাবে চলতে চাই। আমি চিন্তা করি পুরুষরা এটা করতে পারছে, তাহলে আমি করতে পারব না কেন? আমিও এটা পারব। প্রথমদিকে আমার যে দুর্বলতাগুলো ছিল, তা যে ভালো জানে তার কাছ থেকে শিখেছি- বলেন ডিএসইর সাবেক এই পরিচালক।
ডিএসইর মেম্বারশিপ নেয়ার পর পুরুষ মেম্বাররা সহজভাবে নেইনি এমন তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথমদিকে এখানকার (ডিএসই) পুরুষ মেম্বাররা আমাকে ওইভাবে নেইনি। তারা আমাকে তাদের সমকক্ষ মনে করেনি। তারা মনে করেছে একটা মেয়ে মানুষ এসেছে, কয়েকদিন পরেই হয়তো চলে যাবে। কারণ এটা একটা রুক্ষ-সুক্ষ সাবজেক্ট। এত রুক্ষ বিষয়ে মেয়েদের থাকা এত সহজ নয়। কিন্তু আমি প্রমাণ করে দিয়েছে মেধা, ইচ্ছা এবং সাহস থাকলে পারা যায়, যে কোনো বাধা, বাধা না। একজন নারী পুরুষের সঙ্গে অবশ্যই তাল মিলিয়ে চলতে পারে।
নারীদের বাধা অতিক্রমের বিষয়ে তিনি বলেন, নারীদের বাধা নারী নিজেই। জন্মের পরপরই তাকে শেখানো হয় এ কাজগুলো মেয়েরা করবে, এ কাজগুলো ছেলেরা করবে। পরিবার থেকেই এ বাধা আসে। নারীকে প্রতিটি পদক্ষেপেই ভাবতে শেখায় এ কাজটা তার জন্য না। এ জায়গাটার উত্তরণ ঘটাতে হবে নিজের পরিবার থেকেই এবং নারীকে নিজের সঙ্গে কথা বলে এগোতে হবে যে, একটা পুরুষ পারলে আমি পারব না কেন।