দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ও সমমানের ডিগ্রি কীভাবে অনুমোদন করা হয়, সেগুলো যথাযথ আইন মেনে হয়েছে কি না তা জানতে চেয়ে হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং ঢাবির অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করা হবে আজ। এরপর এ বিষয়ে শুনানির জন্যও নির্ধারিতে রয়েছে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ।
সোমবার (১১ জানুয়ারি) হাইকোর্টের বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলম এর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে প্রতিবেদনটি দাখিল ও শুনানির জন্য রয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এবিএম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ও সমমানের ডিগ্রি কীভাবে অনুমোদন করা হয়, সেগুলো যথাযথ আইন মেনে হয়েছে কি না তা জানতে চান। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) এবং ঢাবিকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন আদালত।
একই সঙ্গে ‘ঢাবির শিক্ষকের পিএইচডি গবেষণার ৯৮ শতাংশ নকলের’ বিষয়টি তদন্ত করে ৬০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান চূড়ান্ত হওয়ার আগে জালিয়াতির ঘটনা রোধে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে যাচাই-বাছাই কেন করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়। জালিয়াতি রোধে কেন ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে।
এ ছাড়া শিক্ষার্থী বা গবেষকদের পিএইচডি বা সমমানের ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে জালিয়াতি রোধে থিসিসের প্রস্তাব চূড়ান্ত করার আগে আইসিটি বিশেষজ্ঞ নিয়োগের মাধ্যমে থিসিস প্রস্তাব যাচাইয়ে পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়।
শিক্ষাসচিব, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিবাদীদের এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
এ সংক্রান্ত বিষয়ে করা রিটের শুনানি নিয়ে ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি এ কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেন।
আদালতে ওইদিন রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান লিংকন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
সেদিন আইনজীবীরা জানিয়েছিলেন, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কোন নীতিমালার আলোকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করছে- তা তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ইউজিসিকে তদন্ত করে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।
একই সঙ্গে ঢাবির এক শিক্ষকের পিএইডি জালিয়াতির ঘটনায় তদন্ত করে ঢাবি উপাচার্যকে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেন আদালত। এ ছাড়া এসব জালিয়াতি রোধে এবং নকল গবেষণা নিয়ে রুল জারি করা হয়।
এর আগে ‘ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি গবেষণার ৯৮% নকল’ শিরোনামে গত বছরের ২১ জানুয়ারি গণমাধ্যমে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এর পরের দিন (২২ জানুয়ারি) এ বিষয়ে রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনিরুজ্জামান লিংকন। যদিও গত ২৮ জানুয়ারি ওই শিক্ষককে অব্যাহতি দেয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৯৮ শতাংশ হুবহু নকল পিএইচডি গবেষণার (থিসিস) মাধ্যমে ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবুল কালাম লুৎফুল কবীর।
২০১৪ সালের দিকে ‘টিউবার কিউলোসিস অ্যান্ড এইচআইভি কো-রিলেশন অ্যান্ড কো-ইনফেকশন ইন বাংলাদেশ: অ্যান এক্সপ্লোরেশন অব দেয়ার ইমপ্যাক্টস অন পাবলিক হেলথ’ শীর্ষক ওই নিবন্ধের কাজ শুরু করেন আবুল কালাম লুৎফুল কবীর। তার এই গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আবু সারা শামসুর রউফ আর সহতত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজ শুরুর এক থেকে দেড় বছরের মাথায় ২০১৫ সালে অভিসন্দর্ভের (গবেষণা) কাজ শেষ করে ফেলেন লুৎফুল কবীর। একটি পিএইচডি অভিসন্দর্ভের কাজ শেষ করার জন্য সাধারণত তিন থেকে সাড়ে তিন বছর লাগে। কিন্তু দ্রুত কাজ শেষ করে প্রথমে সহতত্ত্বাবধায়কের স্বাক্ষর ছাড়াই ডিগ্রির জন্য অভিসন্দর্ভটি জমা দেন লুৎফুল কবীর। সহতত্ত্বাবধায়কের স্বাক্ষর না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবন থেকে তা ফিরিয়ে দেয়া হয়। পরে লুৎফুল কবীর গবেষণার সহতত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক ফারুককে ‘অনেক অনুনয়-বিনয়’ করে তার কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে এলে ২০১৫ সালেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে তা অনুমোদিত হয়।
গবেষণায় ৯৮ শতাংশ হুবহু নকলের বিষয়টি নজরে আসার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে একজন গবেষক ঢাবি উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের কাছে বিষয়টি নিয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। এ ছাড়া লুৎফুল কবীরের অভিসন্দর্ভে নিজের একটি গবেষণা থেকে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ও তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানকে একটি চিঠি দেন সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোনাস নিলসন।
পরে ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবুল কালাম লুৎফুল কবীরকে প্রশাসনিক ও শিক্ষা কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।