প্রধান ফটক পেরুতেই চোখে পড়ে বাগানবিলাস ফুলের সতেজ সম্ভাষণ। ভিতরে ঢুকে দেখা যায় ছিমছাম পরিচ্ছন্ন কক্ষ।
প্রয়োজনীয় নির্দেশনাগুলো ঝুলিয়ে দেওয়া আছে নোটিস বোর্ডে। নেই দালালের চিরচেনা আনাগোনা। এই সুশৃঙ্খল পরিবেশ দেখে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই এটি একটি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস।
সরেজমিন উত্তরা পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দেখা যায়, যে কোনো তথ্যের জন্য গেট দিয়ে ঢুকতেই রয়েছে অনুসন্ধান ডেস্ক। এখানে কাজের বিষয়ে বললে কাউন্টারের দায়িত্বরত কর্মী জানিয়ে দেন প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। এখানে পাসপোর্টের আবেদন ফরম জমা দিতে আসেন মানুষ। কাউন্টারে ফরম জমা দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই ডাক পড়ে ছবি ওঠানো, আঙ্গুলের ছাপ দেওয়া এবং তথ্য পূরণের জন্য। সেখান থেকে পাসপোর্ট গ্রহীতাকে দিয়ে দেওয়া হয় রিসিভ কপি। আর এখানেই শেষ হয় পাসপোর্ট অফিসের কাজ। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে পাসপোর্টের আবেদনকারীর তথ্য অনুসন্ধান করে পাসপোর্ট অফিসে রিপোর্ট পাঠানোর দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই দিয়ে দেওয়া হয় পাসপোর্ট। অথচ এই কাজের জন্য মানুষকে পাসপোর্ট অফিসে ঘুরতে হতো দিনের পর দিন। অগত্যা ঝামেলা এড়াতে টাকা দিয়ে ধরতে হতো দালাল। অনলাইনে ফরম প্রাপ্তি এবং পাসপোর্ট অফিস ব্যবস্থাপনার পরিবর্তনে ভোগান্তি কমেছে মানুষের। খিলক্ষেত থেকে এসেছেন সুমন শেখ। পাসপোর্ট হারিয়ে নতুন পাসপোর্ট করতে এসেছেন তিনি। সেবা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তিনি বলেন, দেড় বছর আগে পাসপোর্ট করাতে এসে তিন দিন ঘুরে ছবি তুলতে পেরেছি। এর সঙ্গে দালালের টানাহেঁচড়া তো ছিলই। পাসপোর্ট হারিয়ে আবার যখন এখানে আসতে হলো তখন ভাবতেই টেনশন লাগছিল। এবার উত্তরা অফিসে এসে দেখি চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। দুই ঘণ্টার মধ্যে আমার সব কাজ শেষ। সেবার মান দেখে মনে হচ্ছে, সরকারি অফিস নয়, কোনো কর্পোরেট অফিসে এসেছি।
দালালের দৌরাত্ম্য এবং ভোগান্তি কমাতে অনলাইনে পাওয়া যায় পাসপোর্ট ফরম। ফরম ডাউনলোড করে চাহিদামাফিক তথ্য দিয়ে পূরণ করতে হয়। এরপরের কাজ হলো ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া। নিয়মিত পাসপোর্টের জন্য জমা দিতে হয় ৩ হাজার ৪৫০ টাকা এবং জরুরি পাসপোর্টের জন্য দিতে হয় ৬ হাজার ৯০০ টাকা। ব্যাংকের রসিদ এবং ফরম জমা দিতে হয় পাসপোর্ট অফিসে।
আগারগাঁও বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন মানুষ। কেউ হারিয়ে ফেলেছেন পাসপোর্ট, কেউ নতুন পাসপোর্ট করছেন। আবার কারও পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন কাউন্টারে দেওয়া হচ্ছে সেবা। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিরপুর-২ এলাকার বাসিন্দা রহিদুর রহমান। তিনি বলেন, এখানে খুব শক্তভাবে সিরিয়াল মানা হচ্ছে। অফিসের ভিতরে দালালের টানাটানিও নেই। পাসপোর্ট অফিসের প্রচার এবং সেবা সহজ হওয়ায় দালালবিমুখ হয়ে পড়েছেন পাসপোর্টের আবেদনকারীরা।
উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের নোটিস বোর্ডে লেখা আছে, ‘অভিযোগ থাকলে ৫০২ নম্বর কক্ষে যোগাযোগ করুন’। অভিযোগের খোঁজে ৫০২ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, দরজায় নামফলকে লেখা, সহকারী পরিচালক আজিজুল ইসলাম। ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে ঘরের কোণে টেবিলের ওপর, সোফার হাতলে সাজানো বিভিন্ন রকমের ছোট বড় গাছ। ক্যাকটাস, বনসাই আর পাতাবাহারের নির্মল ছোঁয়ায় পরিচ্ছন্ন কক্ষ। যে কোনো সমস্যায় মানুষ সরাসরি কথা বলতে পারেন অফিসের এই শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে। আন্তরিক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছরের শ্রেষ্ঠ পাসপোর্ট কর্মকর্তার সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এত মানুষের অভিযোগ, সমস্যা শুনতে বিরক্ত লাগে কিনা জানতে চাইলে আজিজুল ইসলাম বলেন, মানুষ আসলে কথা বলে শান্তি পায়। মানুষের কথা শোনাও একটা সার্ভিস। আর আমি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণ পরিবর্তনে। মানুষকে সেবা দেওয়ার মানসিকতা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা থাকলে ভালো সেবা দেওয়া সম্ভব। কারও পাসপোর্টের তথ্যগত সমস্যা বা কোনো কারণে দেরি হলে আমরা ফোন করে এবং এসএমএস করে জানিয়ে দিই। তিনি বলেন, আমাদের পুরো অফিস পরিচ্ছন্ন করে একমাত্র পরিচ্ছন্নতাকর্মী কিরণ মল্লিক। এই কাজের পাশাপাশি অফিসজুড়ে গাছ লাগানো এবং পরিচর্যাও তার হাতের চমক।
২০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে মানুষের ভোগান্তি কমিয়ে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
এদিকে যাত্রাবাড়ী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের চিত্রও পাল্টে গেছে। নেই দালালের হয়রানি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দরজা সবার জন্য খোলা। সমস্যা নিয়ে যে কেউ তার কাছে যেতে পারেন। সেবা গ্রহীতাদের কোনো অভিযোগ নেই। অসুস্থ, প্রবীণ নাগরিকদের জন্য দেওয়া হয় বিশেষ সেবা। তবে রায়েরবাগ এলাকা থেকে যাত্রাবাড়ী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে যেতে ভাঙাচুড়া রাস্তার কারণে নাগরিকদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। বৃষ্টি হলেই পানি জমে রাস্তায়।
যাত্রাবাড়ী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের শীর্ষ কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক মাকসুদুর রহমান বলেন, আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। ছোটখাটো সমস্যার কারণেও কাউকে ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। প্রয়োজনে নির্ধারিত সময়ের আগেই পাসপোর্ট ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে।