পাশের হারে কেন এই পার্থক্য?

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গড় পাশের হার ৯৫.২৬ শতাংশ। তবে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে শুধু এইচএসসি পরীক্ষায় গড় পাশের হার ৯৫ দশমিক ৫৭। মাদ্রাসা বোর্ডে পাশের হার ৯৫.৪৯ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে পাশের হার ৯২.৮৫ শতাংশ। ২০১৯ সালে পাশের হার ছিল ৬২ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২০২০ ছিল অটোপাশ, আর পাশের হার ছিল ১০০ শতাংশ। এ অটোপাশ দ্বারা কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না আর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানসিক তৃপ্তি বলতে কিছুই ছিল না।

ঢাকা বোর্ডে পাশের হার ৯৬.২০ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫৯ হাজার ২৯৯ জন। রাজশাহী বোর্ডে পাশের হার ৯৭.২৯ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩২০০ হাজার ৮০০ জন। দিনাজপুর বোর্ডে পাশের হার ৯২.৪৩ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৫ হাজার ৩৪৯ জন। বরিশাল বোর্ড থেকে এবার ৬৮ হাজার ৪৪১ জন বেশি শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেছিল, কিন্তু পাশ করেছে ৬৩ হাজার ৯৬৪ জন। ৯ হাজার ৯৭১ জন পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এ বছর এ বোর্ডে ৯৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করেছে। গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে বরিশাল বোর্ডে ৫ হাজার ৫৬৮ জন পরীক্ষার্থী এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। কুমিল্লা বোর্ডে ১৪ হাজার ১৫৩ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এ বছর বোর্ডের ৯৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করেছে। গত বছর এ বোর্ডের ৯ হাজার ৩৬৪ জন পরীক্ষার্থী এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। সিলেট বোর্ডে পাশের হার ৯৪.৮০ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৭৩১ জন। চট্টগ্রাম বোর্ডে পাশের হার ৮৯.৩৯ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৩ হাজার ৭২০ জন। ময়মনসিংহ বোর্ডে পাশের হার ৯৫.৭১ শতাংশ জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭ হাজার ৬৮৭ জন। যশোর বোর্ডে পাশের হার ৯৮.১১ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ২০ হাজার ৮৭৮ জন। রাজশাহীতে ৯৭.২৯ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৮৯.৩৯ শতাংশ পাশ করেছে।

২০২১ সালে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে মোট ১৪ লাখ ১৪৫ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। পরীক্ষা শুরু হয় ২ ডিসেম্বর, শেষ হয় ৩০ ডিসেম্বর। এক মাসের মধ্যে ফল প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই হিসাবে জানুয়ারির শেষে কিংবা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ফল প্রকাশের কথা। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার উত্তর আসতে বিলম্ব হওয়ায় ফল তৈরিতে বিঘ্ন ঘটে। আমরা জানি, এবার সব বিষয়ে পরীক্ষা হয়নি। শুধু বিভাগভিত্তিক তিনটি করে নৈর্বাচনিক বিষয়ে এ পরীক্ষা নেওয়া হয়। তবে, অন্যান্য বিষয়ে এসএসসি ও জেএসসিতে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ‘সাবজেক্ট ম্যাপিং’ করে শিক্ষার্থীদের গ্রেডিং দেওয়া হয়।

২০২০ সালে এগারটি শিক্ষা বোর্ডের ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন শিক্ষার্থীর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল ১ এপ্রিল ২০২০। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে শুরু করলে ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর গত ৭ অক্টোবর পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার মতো এইচএসসি পরীক্ষাও বাতিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিশেষ ব্যবস্থায় মূল্যায়নের কাজটি করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। বিভাগ পরিবর্তনজনিত কারণে যে সমস্যাটি হওয়ার কথা, তা ঠিক করতেও বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করেছিল। বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত অনুযায়ীই ফল প্রকাশ করা হয়েছিল। তাদের মতামত অনুযায়ী জেএসসি/সমমানের আবশ্যিক বাংলা, ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ের নম্বরের ২৫ শতাংশ এবং এসএসসি/সমমান পরীক্ষার আবশ্যিক বাংলা, ইংরেজি ও আইসিটির ৭৫ শতাংশ নম্বর বিবেচনা করে এইচএসসির আবশ্যিক বাংলা, ইংরেজি ও আইসিটির নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন গ্রুপের নম্বরের ক্ষেত্রে গ্রুপভিত্তিক বিষয়ের নম্বর প্রায় একইভাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। বিভাগ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জেএসসি/সমমান পরীক্ষার গণিত এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বরের ২৫ শতাংশ, এসএসসি/সমমান পরীক্ষার গ্রুপভিত্তিক পরপর তিনটি বিষয়ের ৭৫ শতাংশ নম্বর বিবেচনা করে এইচএসসির মানবিক ও অন্যান্য গ্রুপে তিনটি বিষয়ের নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছিল। এটি নিয়ে আমরা অনেক সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু এ ছাড়া খুব অতিরিক্ত কিছু করার উপায় ছিল না। তাই মন্ত্রণালয়কে এ ধরনের সিদ্ধান্তই নিতে হয়েছে। তবে, ইংরেজি মাধ্যমের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষার্থীরা আগের নিয়মেই পাবলিক পরীক্ষায় বসে ফল পেয়েছে, যেটি সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে হয়নি।

২০১৯ সালের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট ও সমমানের পরীক্ষায় গড় পাশের হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ফলাফলে সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৪৭ হাজার ২৮৬ জন, যা মোট পরীক্ষার্থীর ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। পরীক্ষার্থী ছিল ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ জন, পাশ করেছিল ৯ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন। এবার ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন পরীক্ষার্থীকে জিপিএ-৫ দেওয়া হয়েছে। ৯টি সাধারণ বোর্ড থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬১৪ জন, আর আলিমে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৪৮ জন। কারিগরিতে-জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ১৪৫ জন অর্থাৎ ৩ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে জিপিএ-৫ বেড়েছে তিনগুণ। এসএসসিতে যারা জিপিএ-৫ পায়নি তাদের ১৭ হাজার জিপিএ-৫ পেয়েছে, যা উলটো মনে হচ্ছে; কারণ উচ্চমাধ্যমিকে সাধারণ এসএসসির চেয়ে ফল নিম্নমানের হয়ে থাকে। দু’একজনের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে যেটি হয়েছে সেটি ব্যতিক্রম নয়, অস্বাভাবিকতা।

করোনা মহামারির পরিবর্তিত পরিস্থিতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়ন, অবিরত মূল্যায়ন বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। সামেটিভ মূল্যায়ন পদ্ধতি দিয়ে একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না। আমাদের শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সর্বোপরি পুরো ব্যবস্থা অবিরত মূল্যায়ন অর্থাৎ ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতির জন্য প্রস্তুত করতে হবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে যাতে রিজন্যাবল পরীক্ষা নেওয়া হয়, সে বিষয়টি লক্ষ রাখতে হবে। শিক্ষার্থীরা বহুদিন ধরে বইয়ের সঙ্গে, প্রকৃত লেখাপড়ার সঙ্গে সেভাবে সংযুক্ত নেই। তাদের আমরা কোনোভাবেই সেজন্য দায়ী করতে পারি না। পরীক্ষা দিয়ে ফল অর্জন করার মধ্যে যে আনন্দ, সেই আনন্দ থেকে শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হচ্ছে; কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সেটি যাতে না হয়, সেদিকে আমাদের সবার দৃষ্টি দিতে হবে। গতবারের চেয়ে এবার ৩৩ হাজার ৯০১ জন পরীক্ষার্থী বেশি ছিল। গ্রুপভিত্তিক তিনটি বিষয়ে নম্বর ও সময় কমিয়ে দেড় ঘণ্টার পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বহু নির্বাচনি ও সৃজনশীল অংশের পরীক্ষার মধ্যে কোনো বিরতি ছিল না। দেশের ১৯৩৪ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাশের হার শতভাগ, তবে পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাশ করতে পারেনি। শতকরা পাশ করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের ৭৩৬টি, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের এক হাজার তিনটি ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ১৯৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২২ শিক্ষার্থী। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন আলিম পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৮৭২ জন, আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫ হাজার ৭৭৫ জন।

পাশের হারের দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে যশোর বোর্ড। এ বোর্ডে পাশের হার ৯৮.১১ আর সবচেয়ে পেছনে রয়েছে চট্টগ্রাম বোর্ড। এ বোর্ডে পাশের হার ৮৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। জিপিএ-৫ প্রাপ্তির দিক দিয়ে সব বোর্ডের শীর্ষে আছে রাজশাহী বোর্ড, আর পিছিয়ে আছে সিলেট বোর্ড। পাশের হারে এক বোর্ড থেকে আরেক বোর্ডের এগিয়ে থাকা কিংবা পিছিয়ে যাওয়ার কারণ কোনো বছরেই খতিয়ে দেখা হয় না। সব বোর্ডেই একই কারিকুলাম অনুসরণ করা হয়; একইভাবে সব বোর্ডেই সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকরা পড়ান, সবার কর্মঘণ্টা একই, সব বোর্ডেই গ্রাম ও শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, কর্মদিবস একই, তারপরও কেন এত পার্থক্য? এর কারণ আমাদের খোঁজা উচিত, জানা উচিত, সবাইকে জানানো উচিত। প্রতিটি বোর্ডেই এজন্য একটি গবেষণা সেল থাকা একান্ত প্রয়োজন, কিন্তু কেউই বোধ করছি বিষয়টি নিয়ে একেবারেই চিন্তিত নন।

মাছুম বিল্লাহ : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত; সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক

masumbillah65@gmail.com