পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে কঠোর হচ্ছে সরকার

:
: ৬ years ago

দেশ থেকে প্রতিবছরই অর্থ পাচার বাড়ছে। কিন্তু তা ফেরত আনার ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রচুর সমালোচিত হতে হচ্ছে। এই অবস্থায় নির্বাচনের আগে বিদেশে পাচারকৃত টাকা ফেরত আনার বিষয়ে কঠোর হচ্ছে সরকার।

সোমবার বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ ফেরত আনার বিষয়ে পুনর্গঠিত টাস্কফোর্সের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় কাউকে ছাড় না দিয়ে বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহসহ প্রয়োজনীয় কার্যক্রম হতে নেয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।

যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পাচার আটকাতে হবে। ফেরত আনা খুব কঠিন ও প্রক্রিয়া দীর্ঘ। কতটুকু সাফল্য আসবে তা নির্ভর করবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের ইচ্ছার ওপর।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সোমবার অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন মাহবুবে আলম। সভায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের প্রতিনিধি ছাড়াও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিআইএফইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় উপস্থিত বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিআইএফইউ) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিভিন্ন কারণে দেশের অর্থ পাচার হচ্ছে। কোনোভাবেই আটকানো যাচ্ছে না। এই অবস্থায় এখন পর্যন্ত পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনতে আমরা পুনর্গঠিত কমিটির মিটিং করেছি।

তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন সংস্থার কাছে অর্থ পাচারের বিষয়ে যেসব তথ্য রয়েছে, তা সংগ্রহ করে একটা ফাইল করব। এই তথ্য ধরেই পরবর্তী কার্যক্রম চালাবে কমিটি। প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর এই কমিটির মিটিং হবে। মিটিংয়ে কাজের অগ্রগতির বিষয়ে ফলোআপ করা হবে।

মিটিংয়ে উপস্থিত দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, আমরা অর্থ পাচার বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছি। তালিকায় যার নামই আসুক ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট আন্তঃসংস্থাগুলোর কার্যক্রমে আরও সমন্বয় সাধন হবে।

পানামা পেপারসে বাংলাদেশিদের নাম উঠে এসেছে। এরপর বহুল আলোচিত প্যারাডাইস পেপারসের দ্বিতীয় তালিকায় ২০ বাংলাদেশির নাম আসে। এদের সবাই অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে অর্থ পাচার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসে (আইসিআইজে) তালিকা প্রকাশ করে।

নিজেদের সক্ষমতা ও অন্যান্য সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাবে এদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্ত জনবল নিয়োগ ও দক্ষতা বাড়ানোসহ সংশ্লিষ্ট আন্তঃসংস্থাগুলোর কার্যক্রমে আরও সমন্বয় সাধন করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। দুদক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাচার যাওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। এর আগে অর্থ ফেরত আনার নজির আছে।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা প্রায় আট কোটি টাকা বাংলাদেশে ফেরতের আদেশ দিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরের একটি আদালত। সোনালী ব্যাংকের রমনা কর্পোরেট শাখার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অ্যাকাউন্টে এ টাকা (নয় লাখ ৩২ হাজার মার্কিন ডলার) আনে।

তবে বাংলাদেশ থেকে বিশাল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে ৯১১ কোটি ডলার সমমূল্যের প্রায় ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে (২০০৫-১৪) বাংলাদেশ থেকে অন্তত ছয় লাখ ছয় হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এ অংক আমাদের মোট জাতীয় বাজেটের দ্বিগুণ। এটা উৎকণ্ঠার বিষয়। কারণ প্রতি বছর টাকা পাচারের হার বাড়ছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, স্বাধীনতার পর থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তা যদি দেশে বিনিয়োগ করা হতো তাহলে দেশের চেহারাই পাল্টে যেত। এমনকি যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তার অর্ধেকও যদি বিনিয়োগ করা হতো, ওই বিনিয়োগ থেকে উৎপাদিত পণ্য দিয়ে বর্ধিত হারে দেশের চাহিদা মেটানো যেত।

তিনি বলেন, অর্থ ফেরত আনার চেয়ে আটকানো সহজ। ফেরত আনার প্রক্রিয়া অনেক জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি। দুই দেশের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে আনতে হবে। এ জন্য বিদেশ অর্থ পাচার হয়েছে এমন প্রমাণ থাকলেও যদি ওই দেশ আগহী না হয়, তাহলে অর্থ ফেরত আনা সম্ভব না। তবে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূলত ৪টি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। এগুলো হলো- বিদেশ থেকে আনা আমদানি পণ্যের মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রফতানি পণ্যের মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসা।

অর্থনীতিবিদদের ভাষ্যমতে, টাকা পাচার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না হওয়া। অবশ্য দুর্নীতিও টাকা পাচারের অন্যতম কারণ। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে, সেই সঙ্গে দুর্নীতির মাত্রা কমিয়ে আনা গেলে বিদেশে অর্থ পাচার হ্রাস পাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে সরকারের উচিত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।