পরিবহনের ‘কর্মবিরতি’তে জিম্মি সারাদেশ

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

রাজধানীর অভ্যন্তরীণ পথে চলছে না গণপরিবহন। মহাসড়কে নেই দূরপাল্লার বাস। চলছে না পণ্যবাহী যানবাহনও। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বন্ধ বাজারে। রোববার পরিবহন শ্রমিকদের ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতির প্রথম দিনে এমন পরিস্থিতিতে জিম্মি হয়ে পড়ে সারাদেশ। পথে পথে অরাজকতায় সাধারণ মানুষ পড়েন অশেষ দুর্ভোগে। দীর্ঘ পথ হেঁটে গন্তব্যে যান তারা।

সড়ক পরিবহন আইন শিথিলসহ আট দাবিতে সোমবারও কর্মবিরতি পালন করবে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন।

সরকারপন্থি এই ফেডারেশনের ঘোষণা ছিল, কর্মবিরতি কর্মসূচি চলার সময় কাউকে বাধা দেওয়া হবে না। যার ইচ্ছা হয়, গাড়ি চালাতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার উল্টো। আন্দোলনকারী শ্রমিকরা অ্যাম্বুলেন্স চলতেও বাধা দিয়েছেন। মৌলভীবাজারের বড়লেখায় এ কারণে অ্যাম্বুলেন্সে থাকা সাত দিনের এক সংকটাপন্ন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডে সরকারি কলেজের ছাত্রীবাহী বাস ভাংচুর করেন শ্রমিকরা। প্রতিবাদ করায় ছাত্রীদের শরীরে কালি ও পোড়া ইঞ্জিন অয়েল মাখিয়ে দেওয়া হয়।

ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর দাবি, এগুলো তৃতীয় পক্ষের কাজ। শ্রমিকরা কোথাও ভাংচুর করেনি। কাউকে লাঞ্ছিতও করেনি।

সড়ক পরিবহন আইন এখন সংশোধন সম্ভব নয় জানিয়ে জনদুর্ভোগ লাঘবে কর্মবিরতি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত আইন সংশোধনের সুযোগ নেই। তবে শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, শ্রমিকরা সড়ক পরিবহন আইন না বুঝেই কর্মবিরতি পালন করছেন। তিনিও কর্মসূচি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে নীরব রয়েছেন ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা শাজাহান খান। চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি করা কর্মবিরতি কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। পরিবহন নেতারা জানিয়েছেন, মন্ত্রীরা কর্মসূচি প্রত্যাহারের আহ্বান জানালেও তাদের আলোচনায় ডাকেননি। তাই পূর্বঘোষণা অনুযায়ী সোমবারও কর্মবিরতি পালন করা হবে।

ফেডারেশনের সহসভাপতি সাদিকুর রহমান হিরু জানিয়েছেন, সোমবার কর্মবিরতি পালনের পর বিকেলে তারা বৈঠকে বসবেন। ঠিক করবেন পরবর্তী কর্মসূচি কী হবে। তিনি আভাস দেন, মঙ্গলবার থেকে নমনীয় কর্মসূচি দেওয়া হবে।  তিনি জানান, তারাও বুঝতে পারছেন সাধারণ যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ হচ্ছে। তাই বিক্ষোভ মিছিল বা সমাবেশের মতো কর্মসূচি দেওয়া হবে। সড়ক পরিবহন আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে ফেডারেশন।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন  বলেন, দাবি আদায়ের নামে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করেছেন পরিবহন নেতারা। মানুষকে জিম্মি করা আন্দোলন নয়, স্বেচ্ছাচারিতা।

গত ২৯ জুলাই বেপরোয়া বাসের চাপায় রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর আন্দোলনে নামে ছাত্রছাত্রীরা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা এ আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের মুখে আট বছর ঝুলে থাকা আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হয়।

এ আইনে সড়কে অপরাধের সাজা বাড়ানো হয়েছে। বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে প্রাণহানির সাজা তিন বছরের জেল থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালালে জেল হবে ছয় মাস। চালক এবং তার সহকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণও করে দেওয়া হয়েছে এ আইনে।

পরিবহন শ্রমিকরা এ আইনের বিরোধিতা করছেন। তাদের দাবি, সড়ক দুর্ঘটনার মামলা জামিনযোগ্য করতে হবে। পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া যাবে না। সড়ক দুর্ঘটনা তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখতে হবে। চালকের লাইসেন্সপ্রাপ্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণি করতে হবে।

দাবি আদায়ে রোববার সকাল ৬টায় শুরু হয় ‘কর্মবিরতি’ কর্মসূচি। তবে তার আগেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় বাস ও ট্রাক টার্মিনালে অবস্থান নেন শ্রমিকরা। সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেন তারা। অচল হয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’ খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। অভিন্ন চিত্র ছিল অন্যান্য মহাসড়কেও।

সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর সায়েদাবাদ, গাবতলী, ফুলবাড়িয়া ও মহাখালী বাস টার্মিনালে ভোর থেকেই যান চলাচল বন্ধ করে দেন আন্দোলনকারীরা। দিনভর তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনাল থেকেও পণ্যবাহী কোনো যানবাহন ছাড়েনি।

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের সামনে কথা হয় কুমিল্লার দাউদকান্দির এক কারখানা শ্রমিক পরেশের সঙ্গে। তিনি জানান, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে বাড়ি গিয়েছিলেন পূজার ছুটিতে। কর্মস্থলে ফিরতে ট্রেনে ঢাকার কমলাপুর আসেন। তার সঙ্গে স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের আরও তিন সদস্য রয়েছে। ট্রেন থেকে নেমে শোনেন পরিবহন ধর্মঘট চলছে। দাউদকান্দি যাবেন কীভাবে, তা অনিশ্চিত হলেও ব্যাগপত্র নিয়ে কমলাপুর থেকে হেঁটেই সায়েদাবাদ আসেন তারা। সেখানে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেও কোনো বাস বা যানবাহন পাননি তারা। পরে দ্বিগুণ ভাড়ায় রিকশা নিয়ে রওনা হন যাত্রাবাড়ীর দিকে। দুপুরে সায়েদাবাদে  তিনি জানান, সোমবার তাকে কাজে যোগ দিতেই হবে। তিনি স্বল্প আয়ের মানুষ। তাই খরচ বেশি হলেও ভেঙে ভেঙে দাউদকান্দি যাবেন।

রোববার সায়েদাবাদ থেকে দূরপাল্লা, আন্তঃজেলা এবং নগরের ভেতরের কোনো বাস বা মিনিবাসই চলাচল করেনি। দূরপাল্লার বাস কাউন্টারগুলো অধিকাংশই ছিল বন্ধ। কর্মবিরতির কথা না জেনেই অনেক যাত্রী টার্মিনালে এসেছিলেন। যানবাহন না পেয়ে ফিরে যান তারা। স্বল্প দূরত্বের অনেক যাত্রী অ্যাপসভিত্তিক মোটরসাইকেল ও গাড়িতে গন্তব্যে যাত্রা করেন।

রোববার দুপুরে সায়েদাবাদ ঘুরে দেখা যায়, প্রতি সড়কে, টার্মিনালে ও পেট্রোল পাম্পে বাস এবং মিনিবাসগুলো অলস পড়ে আছে। গাজীপুর-সায়েদাবাদ রুটের বলাকা পরিবহনের কর্মী মকবুল জানান, দৈনিক মজুরিতে সংসার চলে তার। গাড়ি না চলায় উপার্জন বন্ধ এখন। পরিবারের খরচ জোগাতে সমস্যা হবে; কিন্তু নিজেদের রক্ষার জন্য বাধ্য হয়েই কর্মবিরতিতে গেছেন।

অভিন্ন চিত্র ছিল গাবতলীতেও। সকালে শ্যামলীতে দেখা যায়, বাস না পেয়ে সাধারণ মানুষ সিটি করপোরেশনের ময়লার কনটেইনারবাহী গাড়িতে করে গন্তব্যে যাচ্ছেন। এ ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিকেলে মতিঝিল এলাকায় দেখা যায়, হাজারো মানুষ গাড়ির অপেক্ষায়। অনেকে বাড়ি ফিরছেন রিকশা ও ভ্যানে করে। কেউ কেউ হাঁটছেন। সকালেও একইভাবে অফিসে গেছেন তারা।

দুপুরে শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কথা হয় রিজওয়ান সিদ্দিকীর সঙ্গে। মাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন জিগাতলা থেকে। বাস না থাকায় অটোরিকশার ভাড়া এখন আকাশছোঁয়া। সকালে ৩৫০ টাকায় এসেছেন ১০ টাকার পথ; কিন্তু দুপুরে অটোরিকশাও পাচ্ছেন না। উবার ও পাঠাওয়ের গাড়িও ভাংচুরের ভয়ে নামছে না রাস্তায়। রাজধানীর সর্বত্রই ছিল একই চিত্র।

ঢাকার মতো চট্টগ্রাম শহরেও অভ্যন্তরীণ পথে বাস চলেনি। সড়কে লেগুনা, অটোরিকশার সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। পথে পথে সেগুলোকে আটকান আন্দোলনকারী শ্রমিকরা। গতকাল বহু শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারেননি। ইফতেখার হোসেন তুহিন তাদেরই একজন। তিনি জানান, কোনো গাড়ি না পেয়ে কালুরঘাট সেতুর মুখ থেকে ফিরে যান।

খুলনা, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের প্রায় সবখানেই সড়ক-মহাসড়কের মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়েছিলেন শ্রমিকরা। বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় গাড়ি বের করা চালকদের মুখে কালি মেখে দেন তারা। পঞ্চগড়ে চলতে দেওয়া হয়নি বিআরটিসির বাসও। অটোরিকশা, ইজিবাইকও চলতে দেওয়া হয়নি কুমিল্লায়। একই দৃশ্য ছিল ঝিনাইদহে। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে বরযাত্রীর গাড়ির চালককে মারধর করেন শ্রমিকরা।

রাজশাহীতে কর্মবিরতি পালন করা শ্রমিকদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। রোববার ১০টার দিকে নগরীর নওদাপাড়া ‘অন্তর পরিবহনে’র বাস থামিয়ে চালককে মারধর করেন আন্দোলনকারী শ্রমিকরা। এর জেরে বাসচালকরা সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের মারধর করেন।

ত্রিশালে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন শ্রমিকরা। একই অবস্থা ছিল ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে। দিনভর ফাঁকা ছিল আরিচা ও মাওয়া ঘাট। ট্যাঙ্কার, লরি না চলায় বাঘাবাড়ী ঘাট থেকে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ রয়েছে উত্তরবঙ্গের সব জেলায়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সোনা মসজিদ ও বেনাপোলসহ সব বন্দরে আটকা পড়েছে ভারত থেকে আসা মালামাল। সড়কে বাস না থাকায় যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করেছে লেগুনার লোকজন।