অবশেষে অনিশ্চয়তা কাটিয়ে পদ্মা সেতুর ১৪টি পিলারের নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। নতুন নকশা মূল সেতু নির্মাণকারী চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। মার্চ মাসের পরই এসব পিলারের পাইল বসানোর কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন পদ্মা সেতু প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একাধিক বিশেষজ্ঞ।
তিনটি পিলারের (খুঁটি) ওপর দুটি স্প্যান বসানোর পর পদ্মা সেতুর ৩০০ মিটার এখন দৃশ্যমান। কিন্তু নদীর মাটির স্তরের ভিন্নতার কারণে সেতুর ১৪টি পিলারের নকশা চূড়ান্ত করা যাচ্ছিল না। তবে সে অনিশ্চয়তা কেটে গেছে।
দুর্নীতির অভিযোগ, অর্থসংকট ও রাজনৈতিক বাহাসের মধ্যে দেশে কয়েক বছর ধরেই আলোচনায় রয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্প। এ প্রকল্পে সিংহ ভাগ অর্থ দেওয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি)। দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে পড়ে। একে একে সরে যায় এডিবি ও আইডিবি। এরপর সরকার নিজস্ব অর্থেই এ সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতু হচ্ছে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরার মধ্যে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ডাঙার অংশ ধরলে সেতুটি প্রায় নয় কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। পিলারের ওপর ইস্পাতের যে স্প্যান বসানো হবে, এর ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। আর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। পুরো সেতুতে মোট পিলার হবে ৪২টি। এক পিলার থেকে আরেক পিলারের দূরত্ব ১৫০ মিটার। এই দূরত্বের লম্বা ইস্পাতের কাঠামো বা স্প্যান জোড়া দিয়েই সেতু নির্মিত হবে। ৪২টি পিলারের ওপর এ রকম ৪১টি স্প্যান বসানো হবে। এর মধ্যে দুটি স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। স্প্যানের অংশগুলো চীন থেকে তৈরি করে সমুদ্রপথে জাহাজে করে আনা হয় বাংলাদেশে। ফিটিং করা হয় মাওয়ার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে।
৪২টি পিলারের মধ্যে ২৮টি পিলারের পাইল বসানোর কাজ প্রায় শেষের পথে। প্রতিটি পিলারে পাইলের সংখ্যা ছয়। সব মিলিয়ে ২৪০টি পাইল বসানোর কথা ছিল। ইস্পাতের এসব পাইল মাটির নিচে ৯৬ থেকে ১২৮ মিটার পর্যন্ত গভীরে বসানো হচ্ছে। তবে ১৪টি পিলারের পাইল বসানোর সময় মাটির স্তরে কাদামাটি পাওয়া যায়। এই পিলারগুলোর নম্বর হলো ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ২৬, ২৭, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২ ও ৩৫। আগের নকশা অনুযায়ী এই ১৪টি পিলারের পাইলের সংখ্যা ছিল ৮৪। সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করে ব্রিটিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাউই (COWI) ইউকে লিমিটেড।
প্রতিষ্ঠানটির বিশেষজ্ঞরা মাটি পরীক্ষার প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন তথ্য যাচাই করেন। তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী, কাদামাটির পরই শক্ত মাটি না পাওয়ায় এখন পদ্মা সেতুর ১৪টি পিলারের মধ্যে পাইলের সংখ্যা একটি করে বাড়ানো হবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ‘১৪টি পিলারে পাইলের সংখ্যা বাড়তে পারে। কোনো কোনো পিলারে পাইলের প্রয়োজন হবে সাতটি। পাইলের সংখ্যা বাড়লেও গভীরতা কমে আসবে।’
পদ্মা সেতু প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন নকশা অনুযায়ী পাইলের সংখ্যা একটি করে বাড়লেও গভীরতা ১২৮ মিটার থেকে ৪ মিটার বা এর চেয়ে বেশি কমিয়ে আনা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ দলের একজন সদস্য জানান, পদ্মা বিশ্বের বিপজ্জনক একটি নদী। উজান থেকে আসা গঙ্গা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি পদ্মার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। প্রায় ২০ কিলোমিটার পানির প্রবাহ যেখানে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে, এর আশপাশের এসে সরু হয়ে তিন কিলোমিটার এলাকা দিয়ে ভাটির দিকে চলে গেছে। এই নদীর পানির গতি প্রতি সেকেন্ডে চার মিটার। পদ্মা নদী বর্তমানে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত দিয়ে মাদারীপুর জেলার চর জানাজাতের দিকে বয়ে যাচ্ছে। মাওয়ার দিকে চর পড়লে ভবিষ্যতে পদ্মা তার দিক পরিবর্তন করতে পারে। ঠিক একইভাবে নদীর তলদেশের মাটির স্তরও বদলে যায়। আজ যেখানে শক্ত মাটি রয়েছে, আগামী বছর গতিপথ বদলে গেলে নদীর তলদেশও বদলে যেতে পারে। তাই তলদেশের শক্ত মাটির স্তর কাদামাটিতে পরিণত হতে পারে। একইভাবে আজ যেখানে কাদামাটির স্তর রয়েছে, সেখানে ভবিষ্যতে মাটি শক্ত হয়ে যেতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনা করেই পদ্মার ওপর পিলারসহ সেতুর কাঠামোর নকশা করা হয়েছে।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা বলেন, ‘এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি পিলারের নতুন নকশা মূল সেতু নির্মাণে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে।’
তবে ১৪টি পিলারের নকশা পরিবর্তনের কারণে সেতু প্রকল্পের কাজ থেমে নেই বলে জানান বিশেষজ্ঞ দলের একাধিক সদস্য। বিশেষজ্ঞ কমিটির অন্য সদস্য জানান, পিলারের নকশা করার পর এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। খুব শিগগির এটি ঠিকাদার চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির কাছ পাঠানো হবে। ঠিকাদারেরা ৩১ মার্চ পর্যন্ত অন্যান্য পিলারের পাইল বসানোর কাজে জড়িত রয়েছেন। তার আগে মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঠিকাদারকে বলতে হবে কোন কোন পাইল কত মিটার গভীরে পুঁততে হবে। পাইলের সংখ্যা বাড়লেও গভীরতা ১২৮ মিটার থেকে কমে আসবে।
সেতু প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন এক প্রকৌশলী জানান, ১২০ থেকে ১২৪ মিটার গভীরতায় পাইলগুলো বসানো হবে।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এ সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে ১৪টি পিলারের নকশা চূড়ান্ত হলেও নির্ধারিত সময়ে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। গত ২৮ জানুয়ারি জাজিরা প্রান্তে দ্বিতীয় স্প্যান বসানোর সময় সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, পদ্মা সেতুর ৫৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি সাড়ে নয় মাসের মধ্যে অবশিষ্ট ৪৭ শতাংশ কাজ শেষ করতে হবে।
গত ১৮ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, পদ্মা নদীর মাটির লেয়ারের ভিন্নতার কারণে ১৪টি পিয়ার লোকেশনে পাইলের নকশা চূড়ান্ত করতে কিছুটা দেরি হচ্ছে। পাইল ড্রাইভিং এবং পিয়ার কলামের পাশাপাশি অবশিষ্ট স্প্যানগুলো পর্যায়ক্রমে বসানোর মাধ্যমে চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই বছরের ২৮ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার প্রকল্প পাস করেছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয়বারের মতো পদ্মা সেতুর ব্যয় আরও ৮ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফলে পদ্মা সেতুর ব্যয় দাঁড়িয়েছে সব মিলিয়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এই অর্থ মূলত দেশের মানুষের দেওয়া করের টাকা।