পটুয়াখালীর যে গ্রামে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশুরা

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার তেঁতুলিয়া নদী তীরবর্তী একটি ইউনিয়ন চন্দ্রদ্বীপ। ছোটবড় ১৮টি চর নিয়ে গঠিত এই ইউনিয়নের উত্তর চর রায়সাহেব ওয়ার্ডের একটি গুচ্ছগ্রাম উত্তর রায়সাহেব।

গ্রামটি ইউনিয়নের অন্যান্য ওয়ার্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় গড়ে ওঠেনি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে গ্রামের শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ ছাড়া বাড়ছে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমিকের সংখ্যা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গুচ্ছগ্রামটির আশপাশে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে কোনো রাস্তা নেই। রায়সাহেব খালের পাশের খেতের মধ্যে গ্রামটির একমাত্র পথ। গুচ্ছগ্রামে ঢোকার মুখে আছে বিশাল বড় একটি সাঁকো।

এই খেত আর সাঁকো দিয়েই গ্রামের মানুষ ঝুঁকি নিয়ে আসা-যাওয়া করে। তবে বর্ষা মৌসুম ও জোয়ারের সময় এই পথ ডুবে যায়। তখন তাদের যোগাযোগের একমাত্র ভরসা থাকে নৌকা। এর ফলে গ্রামের মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকে না।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই গ্রামের কোনো শিশু স্কুলে যায় না। শিশুকালে তারা কানামাছি, গোল্লাছুট, নদীর পানিতে ডুবসাঁতার, ভোঁ-দৌড়সহ নানা খেলায় মেতে ওঠে।

ছেলেশিশুরা একটু বড় হলেই নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরা শেখে। নদীতে নৌকা চালানো এবং জাল ফেলে জাল তোলা শিখলেই তাকে কর্মঠ কিংবা স্থানীয় ভাষায় ‘জালপাস’ ছেলে বলা হয়। এ ধরনের ছেলেদের বয়স ১৬-১৭ হলেই বিয়ে দেওয়া হয়।

গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা সজীব (৮) নামে এক শিশু বলে, ‘কী করমু কন, আমাগো এই হানে স্কুল নাই। তাই পড়াশোনা করা লাগে না। বেইন্যাকালে (ভোরবেলা) গরুর ঘাস কাইট্টা গোয়ালঘরে দিয়াইছি। এহন বন্ধুগো লগে (সঙ্গে) খেলাধুলা করি। দুপুর ওইলে গরুরে গোসল করাইতে নিমু।’

শাওলিন (৫) নামের এক শিশু বলে, ‘আমাগো একটা স্কুল দিয়েন, হেইলে (তাইলে) আমরা স্কুলে যামু।’

নদীভাঙনে সবকিছু হারিয়ে স্ত্রীসহ চার ছেলেমেয়ে নিয়ে গুচ্ছগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন আবদুর রাজ্জাক চৌকিদার (৬৪)। তিনি বলেন, চরের ৩ একর ১২ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত গুচ্ছগ্রামটিতে ৬০টি ঘর রয়েছে।

এখানে শিশুদের সংখ্যা শতাধিক। এখানে সব পরিবারই জেলে। শিশুদের বয়স ৭-৮ বছর হলেই নদীতে নিয়ে যান অভিভাবকেরা। নদীতে জাল ফেলা, জাল টানা সবই সরেজমিনে শিক্ষা দেওয়া হয়।

এই গ্রামের শিশুরা বইয়ের শিক্ষায় কেউ শিক্ষিত হয়ে বেড়ে ওঠে না। যেসব শিশু নদীতে জাল টানা, জাল ফেলা, নৌকা ঠিকভাবে চালাতে পারে, তারাই এখানে জালপাস নামে পরিচিত।

গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা সালাউদ্দিন ফরাজী (৫৫) বলেন, বর্ষা মৌসুমে চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের চরমিয়াজান, চরকচুয়া, চরদিয়ারা কচুয়া, চরনিমদি, পাঁচ খাজুরবাড়িয়া, কিসমত পাঁচ খাজুরবাড়িয়া, চরবেড়েট, চরওডেলের মতো অন্য চরগুলোর সঙ্গে নৌকা ছাড়া যোগাযোগের কোনো মাধ্যম নেই।

কোনো সড়ক বানানো হয়নি। নেই কোনো সেতু। তাই গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা সব নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক বলেন, শিশুরা পড়াশোনার মধ্যে থাকলে মা-বাবার মধ্যে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা থাকত না। তাই গুচ্ছগ্রামসহ চরাঞ্চলের শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে আরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দরকার।’

এ বিষয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রিয়াজুল হক বলেন, ‘চর রায়সাহেব গ্রামে একটি স্কুলের ব্যবস্থা করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে।’