নীলার জন্য কাঁদছে রায় পরিবার

লেখক:
প্রকাশ: ৪ years ago

নীলা ফিরবে এখনও সেই আশায় থাকেন মা মুক্তি রায়। দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে মুক্তির সংসার ছিল ফুলের বাগান। সেই বাগান থেকে ঝরে যায় নীলা।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় অলকের ডাক শুনে মা চৌকাঠের দিকে দৌড়ে যান। এই বুঝি নীলা এলো। কিন্তু মায়ের মন বড় অবুঝ। শতবার বোঝানোর পরও তিনি কিছুতেই মানতে পারছেন না, নীলা আর ফিরবে না।

মুক্তি রায় নীলার রেখে যাওয়া সবকিছু যতনে রেখে দিয়েছেন। পড়ার টেবিল, শোয়ার খাট, সাজিয়ে রাখা জামাকাপড় সবই আগের মতো আছে। নেই শুধু নীলা। তবুও মা প্রতিদিন তার রেখে যাওয়া জিনিসপত্রের যত্ম নেন। তার আশা, মেয়ে এসে সাজবে, নূপুর পড়ে তার সামনে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু মেয়ে ফিরে না আসায় তিনি এখন পাগলপ্রায়। সব সময় মেয়েকে খুঁজতে থাকেন এখানে-সেখানে।

অলক-নীলা ভাই-বোনের মধ্যে ছিল মধুর সম্পর্ক। বয়সের ব্যবধানও ছিল কম। তাই অলক প্রায় নীলাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যেত। ভাই-বোনের খুনসুঁটি সব সময় লেগেই থাকতো। নীলা হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী অলক রায়। সেই ঘটনা মনে পড়ে এখনো ডুকরে ডুকরে কাঁদেন অলক। প্রিয় বোনকে হারিয়ে একাকী জীবন তার কাছে দুর্বিষহ মনে হয়।

এদিকে, নীলাও ছিল নাচ-গান আর পড়ালেখায় সেরা। মা-বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়ে ডাক্তার হবে। নীলারও ইচ্ছা ছিল মা-বাবার স্বপ্ন পূরণের। কিন্তু তার ওপর দৃষ্টি পড়ে বখাটে মিজানুরের। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে মিজান প্রায়ই নীলাকে উত্ত্যক্ত করতো।

এই তো সেদিন ভাই-বোন এক সঙ্গে বাসায় ফেরার সময় মিজান ভাইয়ের কাছ থেকে নীলাকে তুলে নিয়ে যায়। সেদিন বোনকে বাঁচাতে না পেরে এখনো ডুকরে ডুকরে কাঁদেন অলক।

গত বছর ২০ সেপ্টেম্বর সাভার পৌর এলাকার ব্যাংক কলোনী মহল্লার এ্যাসেড স্কুলের ১০ শ্রেণির শিক্ষার্থী নীলা খুন হন। এ ঘটনায় পরদিন নীলার বাবা নারায়ণ রায় সাভার থানায় মামলা করেন। মামলা তদন্ত করছে সাভার থানা পুলিশ। সর্বশেষ গত ১৮ জানুয়ারি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিন পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মনিকা খান আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন।

নীলার বাবা নারায়ণ রায় বলেন, ছোট একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে কাজ করি। ছেলে-মেয়ে নিয়ে তো ভালোই ছিলাম। কিন্তু আমার মেয়েটাকে বুক থেকে কেড়ে নিলো। ৫ মাস হয়ে গেছে। মামলার তদন্ত চলছে। পুলিশ বলছে, শিগগিরই চার্জশিট দিয়ে দেবে।

 

নারায়ণ রায় বলেন, মেয়েটা মেধাবী ছিল। ছোটবেলা থেকে নাচ, গান শিখছিল। বড় হয়ে গেলে নাচ ছাড়লেও গানটা সে চালিয়ে যেত। নেচে সে পুরষ্কারও পেয়েছে। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ ছিল। এজন্য বাসায় গানের প্র্যাকটিস করতো। তাকে কখনো লেখাপড়ার কথা বলতে হয়নি। চেয়েছিল বড় হয়ে ডাক্তার হবে। মানুষের সেবা করবে। কিন্তু হলো না। যারা আমার মেয়েকে আমার কোল থেকে কেড়ে নিয়েছে আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই।

মেয়েকে হারিয়ে অনেকটাই বাকরুদ্ধ নীলার মা মুক্তি রায়। তিনি বলেন, বুকটা টুকরো টুকরো হয়ে যায় ওর কথা মনে পড়লে। নিজেকে স্থির রাখতে কষ্ট হয়। কষ্ট হলেও তো সত্য, নীলা মারা গেছে। সে আর ফিরে আসবে না। কিন্তু যারা তাকে পৃথিবীতে থাকলে দিল না তাদের আমি ফাঁসি চাই।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাভার থানার পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) নির্মল কুমার দাস বলেন, তদন্ত চলছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ আসামি সাকিব হোসেনকে গ্রেপ্তার করি। তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিছু কার্যক্রম বাকি আছে। শেষ হলে মামলার চার্জশিট দিয়ে দেব। এখন পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

 

কেন খুন করা হলো নীলাকে জানতে চাইলে এ তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, নীলা এবং মিজানুর রহমানের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ঘটনার কিছুদিন আগ থেকে নীলা মিজানুরকে এড়িয়ে চলতো। মিজানুর এটা মেনে নিতে পারেনি। এজন্য সে নীলাকে খুন করে।

প্রসঙ্গত, গত বছর ২০ সেপ্টেম্বর রাতে হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে নীলা রায় ও তার ভাই অলক রায়ের পথরোধ করে মিজানুর রহমান। পরে তার ভাইয়ের কাছ থেকে নীলাকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে তার নিজ পরিত্যক্ত বাড়ির একটি কক্ষে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান। পরে রাতে সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক নীলাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ ঘটনায় নীলার বাবা নারায়ণ রায় ২১ সেপ্টেম্বর মিজানুর রহমান, তার বাবা আব্দুর রহমান ও মা নাজমুন নাহার সিদ্দিকাসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে সাভার থানায় হত্যা মামলা করেন।

মামলায় এখন পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা হলেন- মিজানুর রহমান, তার বাবা আব্দুর রহমান ও মা নাজমুন নাহার সিদ্দিকা, মিজানের সহযোগী সেলিম পহলান, সাকিব হোসেন। মিজানুরের বাবা আব্দুর রহমান ও মা নাজমুন নাহার সিদ্দিকা সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন বলে জানা গেছে। অন্য তিন আসামি কারাগারে আছেন।