৫ মে, ২০১৩। হেফাজতের তাণ্ডবে পুড়ছে দেশ। ভাঙচুর, আগুন, হামলা; রণক্ষেত্র রাজধানীর পল্টন-মতিঝিল। দিনভর ধ্বংসলীলায় দিশেহারা রাজধানীবাসী। রাতে না আরও কী ঘটে! উত্তপ্ত রাজনীতিতে ওই দিনের ঘটনা যেন ‘আগুনে ঘি ঢালা’। তখনও তিনি স্থির। স্থিরচিত্তে বৈঠক করছেন দলের শীর্ষদের নিয়ে। বৈঠক করছেন আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গেও।
দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বললেন, ভরসা রাখুন, রাতেই সাঁড়াশি অভিযান। যা বললেন, তাই ঘটল। এক ভয়াল রাতের অবসান ঘটল অপেক্ষাকৃত কম রক্তপাতের মধ্য দিয়েই। অথচ রাত পোহালেই দৃশ্যপট পাল্টে যেত পারত।
বলছিলাম, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কথা। ওই সময়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। একটি আদর্শের নাম। হিংসার দাবানলে যখন রাজনীতির ঘর পুড়ে ছাই, তখনও তিনি স্থির থেকেছেন, থেকেছেন অবিচল। ছিলেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী রাজনীতিকও। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্তান সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বাবার দেখানো পথেই হেঁটেছেন রাজনীতির দীর্ঘসময়। অথচ এত সমৃদ্ধময় জীবনগল্পে আত্মঅহমিকার লেশমাত্র ছিল না। বিনয়ী, মৃদুভাষী আর বিচক্ষণতার মধ্য দিয়েই তিনি সকলের ‘আশরাফ ভাই’ বলে পরিচিতি পান।
সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের (আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি) সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন সৈয়দ আশরাফ। ওই সময় তিনি দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তুলতে বড় ভূমিকা রাখেন।
১/১১ এর পর যখন টালমাটাল দেশের রাজনীতি, আওয়ামী লীগের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা যখন বিতর্কিত ভূমিকায় সমালোচিত, তখন সৈয়দ আশরাফ শেখ হাসিনার প্রতি অবিচল আস্থা প্রদর্শন করে সংগঠিত রাখেন দলকে।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে সৈয়দ আশরাফ নজরকাড়া ভূমিকা পালন করেন বলেই আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে, এমন প্রচার রয়েছে দলের মধ্যেও। পরে স্থানীয় সরকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি।
আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এই সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক হন ওবায়দুল কাদের
২০০৯ সালের ২৪ জুলাইয় আওয়ামী লীগের অষ্টাদশ সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এরপর ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর দলের উনিশতম সম্মেলনেও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি।
২০১৫ সাল থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিলেন সৈয়দ আশরাফ। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করলেও তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির তেমন কোনও অভিযোগ ওঠেনি। সাদামাটা জীবনযাপনকারী মানুষটি বরাবরই থেকেছেন নির্লোভ-নির্মোহ।
জীবনের বাতিঘরে আঁধার নামিয়ে এ মহান রাজনীতিক চলে গেলেন না ফেরার দেশে। বর্ণাঢ্য জীবনরেখায় আজ যেন বিষাদের ছেদ। প্রিয় ব্যক্তিকে হারিয়ে শোকের সাগরে মাতম করছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। শোক প্রকাশে কার্পণ্য করেননি অন্য দলের নেতারাও। তার মৃত্যুতে হাহাহার বইছে গণমাধ্যমসহ সামাজিক মাধ্যমেও।
দীর্ঘদিন থেকেই দুরারোগ্য ফুসফুস ক্যান্সারে ভুগছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বেশ সময় নিয়ে তিনি থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত শুক্রবার তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের রাজনৈতিক জীবনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সময় কারোর জন্য অপেক্ষা করে না। প্রকৃতি তার নিয়মেই চলে। এই চলমান ধারায় মানুষ কর্মফল রেখে যায়, যা অন্যদের জন্য অনুসরণীয় হয়ে থাকে। আশরাফ ভাই আমাদের কাছে তেমন একজন ব্যক্তিত্ব, যাকে অনুসরণ করতে বিন্দু পরিমাণ দ্বিধা থাকে না। তিনি দুর্দিনে দলকে যেভাবে আগলে রেখেছেন, তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলাদেশের ইতিহাসে। এই মহান রাজনীতিক আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন আলোকবর্তিকা হয়ে।
প্রিয় নেতাকে হারিয়ে অন্যদের মতো বাকরুদ্ধ পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকনেতা আওয়াল কবির জয়ও। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি।
জয় বলেন, সৈয়দ আশরাফ শুধু একটি নাম নয়, তিনি একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। তার জীবনগল্প থেকে যে কেউ রাজনীতি, আদর্শ, নৈতিকতার শিক্ষা সহজেই পাঠ করতে পারেন। এই নির্লোভ ত্যাগী নেতাকে হারিয়ে রাজনীতির যে শূন্যতা সৃষ্টি হলো, তা কখনোই পূরণ হবার নয়। তবে সৈয়দ আশরাফ আমাদের মাঝে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন আদর্শের দিশারি হয়ে।