নিভৃতেই পালিত হল বিশ্ব নৌ-দিবস : বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বরিশাল-ঢাকা নৌপথ

লেখক:
প্রকাশ: ৪ years ago

বরিশালে নিভৃতেই পালিত হল বিশ্ব নৌ-দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘টেকসই নৌ পরিবহন, টেকসই বিশ্ব’। আর এর মূল উদ্দেশ্য হল নৌপথে চলাচলের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পাশাপাশি নিরাপদ নৌরুট গড়ে তোলা।

নৌপরিহন অধিদপ্তরের উদ্যোগে প্রতিবছরই ২৪ সেপ্টেম্বর নৌ দিবস পালিত হয়ে আসছে। আর প্রতিবারই প্রশ্ন উঠেছে দূরপাল্লার বিশেষ করে বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে। নৌদুর্ঘটনায় প্রাণহানি এবং যাত্রীবাহী লঞ্চে একের পর এক খুনের ঘটনায় ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বরিশাল-ঢাকা রুটের নৌপথ। এসব কারণে নৌভ্রমণে আতঙ্ক বিরাজ করছে মানুষের মাঝে।

তাই বিশ্ব নৌ-দিবসে নিরাপদ নদীপথের দাবি জানিয়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। যদিও খুনের ঘটনাগুলোতে দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুতই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অন্যদিকে নৌ দুর্ঘটনার পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে বিআইডব্লিউটিএও। তবে এত কিছুর পরও রোধ করা যায়নি নৌপথে প্রাণহানির মত ঘটনা।

সূত্র মতে, ২০১৫ সাল থেকে চলতি ২০২০ সাল- এ ৬ বছরে অন্তত ৪টি বড়ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা-বরিশাল নৌপথে। এসব দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন যাত্রী। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে নাব্য সংকট, ডুবোচর, রাতে বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল, শীতকালে কুয়াশাসহ একাধিক বিষয়কে দায়ী করছেন লঞ্চের মাস্টাররা। তবে সাধারণ যাত্রীরা তাদের এ দাবি মানতে নারাজ। তাদের অভিযোগ, বেপরোয়া গতিতে লঞ্চচালনা এবং অদক্ষ চালকের কারণে বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে দুর্ঘটনা বাড়ছে।

২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি রাতে চাঁদপুর সংলগ্ন মেঘনায় ঢাকা-বরিশাল রুটে পারাবত-৯ এর সাথে সুন্দরবন-৮ লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই সুন্দরবন-৮ লঞ্চের ১ শিশু ও ২ নারী প্রাণ হারান। ২০১৬ সালের ৪ জুলাই বরিশালের কীর্তনখোলার চরমোনাই পয়েন্টে সুরভী-৭ লঞ্চের ধাক্কায় স্টিমার পিএস মাহসুদের একাংশ দুমড়ে-মুচড়ে যায়। দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫ যাত্রী। ২০১৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে যাত্রীবাহী লঞ্চ শাহরুখ-২ এর ধাক্কায় কীর্তনখোলায় ডুবে যায় এমভি হাজী মো: দুদু মিয়া (রা.)-২ নামের ক্লিংকারবাহী কার্গো। এ ঘটনায় অল্পের জন্য রক্ষা পান উভয় নৌযানের যাত্রী-স্টাফরা। সর্বশেষ চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি দিবাগত রাতে বরিশাল থেকে ছেড়ে যাওয়া কীর্তনখোলা-১০ এবং বরিশালমুখী ফারহান-৯ লঞ্চের সংঘর্ষে মা-ছেলে নিহত হন। আহত হন আরও ৮ যাত্রী।

এসব দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিআইডব্লিউটিএ। সাময়িক স্থগিত করা হয় দায়ী নৌযানগুলোর রুট পারমিট। কিন্তু কিছুদিন পরেই উল্লিখিত লঞ্চগুলো পুনরায় শুরু করে যাত্রী পরিবহন। এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকে। তবে তদন্তের ফলাফল সাধারণের অজানাই রয়ে গেছে।
বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ’র বন্দর কর্মকর্তা আজমল হুদা মিঠু সরকার বলেন, দুর্ঘটনা রোধে লঞ্চ মালিক এবং শ্রমিকদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুর্ঘটনা এড়াতে নৌযানগুলোর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সচল রয়েছে কিনা তা যাচাইয়ের দায়িত্ব নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভে বিভাগের।

এদিকে ঢাকা-বরিশাল নৌপথে বিলাসবহুল লঞ্চে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। গত ৫ বছরে অন্তত ৪ টি খুনের ঘটনা ঘটেছে এই পথে চলাচলকারী লঞ্চগুলোতে।
গত বছরের ২০ জুলাই বরিশালে এমভি সুরভী-৮ এর স্টাফ কেবিন থেকে আঁখি নামে এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল বরিশালগামী পারাবত-৯ লঞ্চে সিফাত নামে এক তরুণীকে হত্যার পর নদীতে ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট ঢাকা থেকে বরিশালগামী পারাবাত-১০ লঞ্চের কেবিন থেকে উদ্ধার করা হয় মিনারা বেগম নামের নারীর লাশ।

সর্বশেষ গত সোমবার (১৪ সেপ্টেম্বর) জান্নাতুল ফেরদৌস লাবনী নামের নারীর লাশ উদ্ধার করা হয় পারাবত-১১ লঞ্চ থেকে। যদিও উল্লিখিত হত্যাকা-গুলোর সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে দুর্বল ব্যবস্থাপনার অভাবে খুনের পূর্বেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে অপারগ ছিলেন লঞ্চ কর্তৃপক্ষ এবং বিআইডব্লিউটিএ। আর এ কারণে ঢাকা-বরিশাল নৌপথে চলাচলকারী যাত্রীবাহী লঞ্চে খুনের মত জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বলে মনে করছেন সাধারণ যাত্রীরা।

এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি ও এমভি সুন্দরবন লঞ্চের স্বত্বাধিকারী সাঈদুর রহমান রিন্টু বলেন, লঞ্চে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। তবে যাত্রীদের ভিড়ে এবং লঞ্চের কেবিনে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলে প্রকৃত খুনিকে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া অনেক কেবিন যাত্রীই মিথ্যা পরিচয়ে লঞ্চে ওঠেন। এজন্য কেবিন ভাড়া নেয়ার আগে প্রতি যাত্রীর পরিচয়পত্র নিশ্চিত করা উচিত। রিন্টু বলেন, লঞ্চের স্টাফরা বাড়তি আয়ের আশায় প্রায় সময়ই নিজেদের কেবিন ভাড়া দিয়ে থাকেন। যে কারণে একাধিক হত্যাকা- ঘটেছে বলে মনে করেন তিনি।