মাটির চুলা। তার কয়েকটি জ্বালামুখ। উত্তপ্ত আগুনের লেলিহান শিখায় সেখানে তৈরি হচ্ছে চিতই, মাংসপুলিসহ নানা পিঠা। এর পাশেই ছোট ছোট বাটিতে থরে থরে সাজানো সর্ষে, মরিচ, শুঁটকিসহ নানা স্বাদের ভর্তা। সেগুলোকে কেন্দ্র করে চারপাশে শিক্ষার্থীদের ভিড়।
কেউ পিঠা খাচ্ছে, কেউ বা করছে অপেক্ষা। কারো কারো লোভাতুর দৃষ্টি তার বর্ণনামতো বানানো গরম পিঠা কখন চুলা থেকে নামানো হবে? ৩২ একরের ক্যাম্পাসের এক কোণের রোজকার চিত্র এটি। বলছিলাম গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিরচেনা মুখ সুজিয়া খালার কথা। খালার হাতের সুস্বাদু পিঠা, ভর্তা আর খালার হাসিমাখা মুখ সকলের পরিচিত। তবে হাসিমুখের পেছনের সংগ্রামের গল্প ক’জনের জানা!
নারী শ্রমিকের অধিকার, মর্যাদা, বৈষম্য দূরীকরণের প্রেক্ষাপটেই নারী দিবস। সকল হার না মানা লড়াইয়ে সুজিয়া খালা যেন তারই প্রতিচ্ছবি। জীবন সংগ্রামের গল্পে তিনি প্রতিনিয়ত প্রশ্ন রেখে চলেছেন ঘুণে খাওয়া সমাজ ব্যবস্থাকে।
সুজিয়া খালা। যার ভালো নাম সূর্যবানু। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিঠা চত্বরে সকাল থেকে বিকেল অব্দি নানা রকমের পিঠা বিক্রিই যার পেশা। সারাদিনের ক্লাস শেষে যার হাতের পিঠাতেই পেটের জ্বালা মেটায় বহু শিক্ষার্থী। এমনকি গবির আড্ডা জমানোর মূল ওষুধই খালার হাতের পিঠা।
সূর্যবানুর গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের দৌলতপুর থানার বাঁচামরা গ্রামে। জীবিকার টানে চলে এসেছেন শহরে। রিকশাচালক স্বামীর একার রোজগারে সংসার চলে না। একটু ভালো খাওয়া পরার আশায় সূর্যবানু চাকরি নেন গার্মেন্টসে। তবে অসুস্থতার কাছে হার মানে সেই প্রচেষ্টা। মুখ থুবড়ে পড়ে তার সংসার। তবে এ সংগ্রামে হার মানেন না সূর্যবানু।
শুরু করেন পিঠার ব্যবসা। শুরুতে রাস্তার পাশে পিঠা বিক্রি শুরু করলে তাতে খুব বেশি সুবিধা হয়না। পরবর্তীতে তিনি আসেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিগত ৬ বছর ধরেই ক্যাম্পাসে পিঠা বিক্রি করেন সকলের প্রিয় সুজিয়া খালা।
পিঠা খেতে খেতেই কথা হয় খালার সঙ্গে। তিনি জানান, তার পুরো সংসার তার ওপর নির্ভরশীল। পিঠা বিক্রি করেই চলে সংসার। সকাল থেকে বিকাল অব্দি পিঠা বিক্রি করে যা রোজগার হয় তাতেই ঘরভাড়া, সন্তানের পড়ালেখার খরচসহ যাবতীয় সবকিছু কোনোমতে চলে।
জীবিকার এই পথচলায় তাকে সাহায্য করেন স্বামী। রিকশা চালানোর ফাঁকে ফাঁকে দোকানে প্রায়ই কাজে সহায়তা করতে দেখা যায় তাকে। সূর্যবানু আরো বলেন, ‘যহন ভার্সিটি পুরাপুরি খুলা থাকে, তখন আমার সংসারটাও ইকটু ভালো চলে। ভার্সিটি বন্ধ থাকলে আমার সংসার চালাইতে কষ্ট হয়।’
এই পিঠা বিক্রিই তার জীবিকার একমাত্র মাধ্যম। জীবিকার টানে যেমনি তিনি দিনভর পিঠা বিক্রি করেন। তেমনি দীর্ঘদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি মায়া জন্মেছে সুজিয়া খালার। খালা বলেন, ‘অনেক সময় ভিড় বেশি থাকে, একা বানায়া সারতে পারি না। পোলাপান পিঠার জন্য দাঁড়ায় থাকে। তাড়াতাড়ি করি। অনেকেই সকালে না খায়া আসে, পিঠা খায়াই তো সারাদিন ক্লাস করে।’
জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার সামনে সকল বাধাকে তুচ্ছ করতে যে মনোবলই যথেষ্ট তার প্রমাণ রোজই দিয়ে যাচ্ছেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলের প্রিয় এই সুজিয়া খালা।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।