নানা-নানির কবরের পাশে শেষঘুমে রাজীব

:
: ৬ years ago

নানা-নানীর কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে ঢাকায় দুই বাসের চাপায় হাত হারানো তিতুমীর কলেজের মেধাবী ছাত্র রাজীব হোসেনকে।

বুধবার সকাল ৯টায় বাউফল পাবলিক মাঠে দ্বিতীয় জানাজা ও সকাল ১০টায় নিজ বাড়ির সামনে তৃতীয় জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।

রাজিবের মামা জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা ঘাতক বাস দু’টির চালকদ্বয়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। যাতে আর কোন রাজীবকে অকালে জীবন দিতে না হয়।

রাজধানীতে দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারিয়ে জ্ঞান ফেরার পর মামাকে বলেছিলেন, ‘বাড়ি যাব। কত দিন গ্রামটা দেখা হয় না।’ শেষ পর্যন্ত মামা জাহিদ চৌকিদার বাড়ি নিয়ে যান ভাগ্নেকে। মঙ্গলবার রাত দুইটার দিকে মরদেহ বহন করা লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি নানাবাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার দাসপাড়া গ্রামে পৌঁছালে গ্রামজুড়েই যেন শোকের মাতম শুরু হয়। হাজারো মানুষ ভিড় করেন রাজীবের নানাবাড়িতে।

বাউফল উপজেলা চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. মজিবুর রহমান বলেন, আজ পুরো বাউফলবাসী রাজীবের পরিবারের পাশে আছেন এবং জনপ্রতিনিধি ও সরকারেরও উচিত রাজীবের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো।

জেলা প্রশাসক ড. মো. মাছুমুর রহমান জানান, সরকার রাজীবের পরিবারের পাশে থাকবে এবং সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।

৩ এপ্রিল বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকের (বাণিজ্য) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন (২১)। রাজধানীর সার্ক ফোয়ারার কাছে হঠাৎ করেই পেছন থেকে স্বজন পরিবহনের একটি বাস বিআরটিসি বাসটিকে ওভারটেক করার চেষ্টা করে। দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের ডান হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্ধার করে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসার জন্য তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে। জ্ঞানও ফিরে আসে। খাবার গ্রহণও শুরু করেছিলেন। কিন্তু গত মঙ্গলবার ভোররাতে অবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়। পরে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। সাত দিন লাইফ সাপোর্টে রাখার পর সোমবার রাত ১২টা ৪০ মিনিটে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক তরুণের সংগ্রামী জীবনের ইতি ঘটল। সব স্বপ্নের ঘটল করুণ সমাপ্তি।

চিকিৎসকরা এই সম্ভাবনাময়-সংগ্রামী তরুণের জীবন বাঁচাতে কতটা সংকল্পে ছিলেন- তা প্রমাণের জন্য এ বক্তব্যই যথেষ্ট। সেই রাজীবের এমন মৃত্যু মানতে পারছেন না তারা। ডা. শামসুজ্জামান শাহীন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের কাছে রাজীবের মৃত্যুর ব্যাপারে বলতে গিয়ে বারবার আবেগাপ্লুত হয়েছেন। তিনি বলেন, এমন টগবগে তরুণের মৃত্যুতে কষ্ট পাচ্ছি। রাজীবের মৃত্যুর ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যে ত্রুটির কারণে এমন মৃত্যু, সেই ত্রুটি সারানো প্রয়োজন। আগেও সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হতেন। এখন তা সংখ্যায় অনেক বেশি।

পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার সূর্যমনি ইউনিয়নের ইন্দ্রকুল গ্রামে রাজীব হোসেনের পৈত্রিক বাড়ি হলেও তিনি বেড়ে উঠেছেন দাসপাড়া গ্রামের নানা বাড়িতে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় ২০০৫ সালে মা নাসিমা বেগমকে এবং অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ২০১১ সালে হারান বাবা হেলাল উদ্দিনকে। বাবা-মার মৃত্যুর পর ছোট দুই ভাইর দায়িত্ব আসে বড় ভাই রাজিব হোসেনের ওপর।

মামা ও খালাদের সহযোগিতায় এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে তিতুমীর কলেজে ভর্তি হন রাজিব। কখনও টিউশনি আবার কখনও কম্পিউটার দোকানে কাজ করে নিজের পড়াশোনা এবং দুই ভাইকে পবিত্র কোরআনের হাফেজ বানিয়েছেন মেধাবী রাজীব। রাজিবের স্বপ্ন ছিল-বিসিএস দিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দিয়ে নামকরা শিক্ষক হবেন। কিন্তু জীবনযুদ্ধের মাঝে হঠাৎ এভাবে না ফেরার দেশে চলে যাওয়াটা ছোট দুই ভাই, আত্মীয়-স্বজন, এলাকাবাসী মানতে পারছেন না।