নব আনন্দে জাগ্রত ধরণী

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

বসন্তের ফেলে যাওয়া দিনগুলোয় জেগে ওঠা বৃক্ষের পাতা এখনও সজীব। গেল কয়েকদিন রাতে কালবৈশাখীর আভাসও মিলেছে। রয়েছে সূর্যের উত্তাপের রুদ্ররূপ। এসব কিছুর মাঝেই বার্তা এসেছে উৎসবের। যার রঙ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায়। বাঙালির সবচেয়ে বড়, সার্বজনীন অসাম্প্রদায়িক সম্মিলনের এদিনে প্রাণ মিলেছে প্রাণের

সঙ্গে; হৃদয় মিলেছে হৃদয়ের সঙ্গে। আজ শনিবার, পহেলা বৈশাখ। জীর্ণ, মলিন সবকিছুকে অগ্নিস্নানে পুণ্য করতে পঞ্জিকায় এসেছে নতুন বছর। শুভ হোক এই নববর্ষ, স্বাগত ১৪২৫।

বড় এক অস্থির সময় পার করছে বিশ্ববাসী। যার ছোঁয়া লেগেছে লালন-হাছন-রবীন্দ্রনাথের বাংলায়ও। মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ, উগ্রবাদীদের আস্ম্ফালনকে ‘তাপসনিশ্বাসবায়ে/ মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে’ নতুন করে পথচলার দিন আজ থেকে। আজ প্রভাতের নতুন সূর্যের কিরণের সঙ্গে সকল অমঙ্গলকে দূরে ঠেলে মঙ্গলের পথে যাত্রা শুরু করেছে বাঙালি। শুধুই কি বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি, অভিবাসী বাঙালিরাও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উদযাপন করছে নতুন বছরের প্রথম দিবসটি। দিকে দিকে আজ কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলছেন- ‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর?/ আসছে নবীন জীবন-হারা অসুন্দরে করতে ছেদন!/ তাই সে এমন কেশে বেশে/ প্রলয় বয়েও আসছে হেসে- মধুর হেসে/ ভেঙে আবার গড়তে জানে/ সে চির-সুন্দর।’

উৎসবে অবশ্য আজ খানিকটা হলেও ভাটা পড়েছে নানা কারণে। মৌলবাদী জঙ্গি অপশক্তির অপতৎপরতাকে বিবেচনায় নিয়ে ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে’ গত দুইবারের মতো এবারও বিকেল ৫টার মধ্যে বর্ষবরণের সব অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরই মাঝে দেশের আপামর জনগণের প্রত্যাশা- নতুন বছরে সব অমঙ্গলকে দূর করে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়বে পূর্ণ শান্তির দ্যুতি।

ঐতিহাসিকদের মতে, বৈদিক যুগে বাংলা সনের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ। মোগল সম্রাট আকবর ফসলি সন হিসাবের সুবিধার্থে বৈশাখ মাসকে প্রথম মাস ধরে বাংলা বর্ষপঞ্জি চালু করেন। নবাব মুর্শিদকুলি খান বৈশাখ মাস থেকে বাংলায় প্রথম খাজনা আদায় শুরু করেন। জমিদারি আমলে বৈশাখের মূল আয়োজন ছিল খাজনা আদায় উপলক্ষে ‘রাজপুণ্যাহ’ ও ব্যবসায়ীদের ‘হালখাতা’ উৎসব। জমিদারি প্রথা বিলোপের পর রাজপুণ্যাহও বিলুপ্ত হয়। আর আধুনিক সময়ে অর্থনৈতিক লেনদেনের ধারায় পরিবর্তন আসায় হালখাতাও তার জৌলুস হারিয়েছে। বর্তমানে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে তাই মুখ্য হয়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, যা প্রবর্তনের কৃতিত্ব পুরোটুকুই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনি শান্তিনিকেতনে প্রথম ঋতুভিত্তিক উৎসবের আয়োজন করেন। বর্তমানে এ উৎসবকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এসেছে নতুন এক গতিশীলতা।

বর্ষবরণ উপলক্ষে আজ পহেলা বৈশাখ শনিবারে রয়েছে সরকারি ছুটি। তবে স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আজ মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নানা সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চলবে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এছাড়া আইনজীবীর মাধ্যমে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সংবাদপত্রগুলোও প্রকাশ করছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।

কর্মসূচি :সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ ব্যবস্থাপনায় জাঁকজমকপূর্ণভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোও বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করছে। এ ছাড়া ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ায় গতবারের মতো এবারও দেশের সব জেলা-উপজেলায় বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। সব কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিশু পরিবারের শিশু ও কারাবন্দিরা সাংস্কৃৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করবে। থাকছে কয়েদিদের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা। জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় জাদুঘর ও প্রত্নস্থানগুলোও সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে।

এবারও পহেলা বৈশাখের মূল আয়োজন হবে রমনা উদ্যানের অশ্বত্থমূলে, যা পরিচিত ‘রমনার বটমূল’ নামে। ছায়ানটের এ আয়োজনের এবারের প্রতিপাদ্য- ‘বিশ্বায়নের বাস্তবতায় শেকড়ের সন্ধান’। এ বিষয়ে কথা বলবেন ছায়ানট সভাপতি ড. সন্‌জীদা খাতুন। সকাল সাড়ে ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বেরুবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এর এবারের প্রতিপাদ্য- ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। যার মধ্য দিয়ে অস্থির সময়ে খাঁটি মানুষের সন্ধানের ডাক দেবেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে রয়েছে চ্যানেল আই ও সুরের ধারার যৌথ আয়োজনে ‘হাজারো কণ্ঠে বর্ষবরণ’। ভোর সাড়ে ৫টায় শুরু হওয়া এ আয়োজন চলবে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর আয়োজনে শিশুপার্কের পাশে নারকেলবীথি চত্বরে অনুষ্ঠিত হবে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান ‘জাগো নব আনন্দে’। এর উদ্বোধন করবেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এতে সম্মাননা জানানো হবে লোকসঙ্গীতশিল্পী আকরামুল ইসলাম, চারুশিল্পী কামাল পাশা চৌধুরী ও বাচিকশিল্পী রূপা চক্রবর্তীকে।

এ ছাড়াও বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, শিশু একাডেমি, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা, বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃৃতিক সংগঠন বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। রাজধানীর পাঁচতারকা হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও, র‌্যাডিসন ব্লু, ওয়েস্টিন, ঢাকা রিজেন্সি, খাজানাসহ হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোর উদ্যোগেও উদযাপিত হবে নতুন বছরের উৎসব। পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবে ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, উত্তরা ক্লাবও।

নববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আজ সকাল সাড়ে ৯টায় গণভবনে দলের কেন্দ্রীয় এবং সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন।

আওয়ামী লীগ সকাল সাড়ে ৭টায় রাজধানীর বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর দলীয় কার্যালয় পর্যন্ত বৈশাখী শোভযাত্রা করবে। শোভাযাত্রা উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) উদ্যোগে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে।