নবনির্মিত কলেজের দরজা খুললে ভেঙে পড়ে ফলস সিলিং

:
: ৪ years ago

পাঁচতলা ভিতবিশিষ্ট পাঁচতলা ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে কয়েক মাস আগে। ভবনটির চতুর্থ তলার স্লাইডিং ডোর ঠিকমতো খোলা বা বন্ধ করা যায় না। খুলতে চেষ্টা করার সময় ফলস সিলিংয়ের কিছু অংশ ভেঙে পড়ে। চতুর্থ তলার দুদিকেই স্লোপিং ছাদ থেকে পানি চুইয়ে পড়ে। স্লোপিং ছাদে আরসিসি ঢালাই দেয়ার কথা, কিন্তু তা করা হয়নি বিধায় পানি চুইয়ে পড়ে। ভবনটির পিলারগুলোও খানিকটা বাঁকা।

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার মালখানগর ডিগ্রি কলেজে নবনির্মিত ভবনের এমনই চিত্র উঠে এসেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে। মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্রটি জানায়, গত ১৩ ও ১৪ নভেম্বর আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী মুন্সিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শনে যান। সেদিন তিনি ‘তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত (বেসরকারি) কলেজসমূহের উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের (বাস্তবায়নকাল ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর) আওতাভুক্ত মালখানগর ডিগ্রি কলেজে নির্মিত পাঁচতলা ভবনটিও পরিদর্শন করেন। ওই সময় তিনি ভবনটির এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখতে পান।

এ বিষয়ে আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী  বলেন, ‘মালখানগর ডিগ্রি কলেজের পূর্ত কাজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো আমার চোখে পড়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে আমি নির্বাহী প্রকৌশলী, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরকে ব্যাখ্যা দিতে বলেছি। পাশাপাশি এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি দ্রুত ঠিক করার বিষয়েও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছি।’

এ বিষয়ে মুন্সিগঞ্জের শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের সহকারী প্রকৌশলী মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা ত্রুটিগুলোর সংশোধন ইতোমধ্যে শুরু করেছি। উপরের স্লাইডিং ডোর ঠিক করা হয়েছে। ফলস সিলিং ঠিক করা হয়েছে। উপরের আরসিসি ঢালাই দেয়া হয়েছে। কলাপসিবল গেট নিচে নামানোর কথা ছিল, সেটা ঠিক করা হয়েছে। এগুলো সব ঠিক করে আমরা ইতোমধ্যে আইএমইডিতে ছবিও পাঠিয়েছি। ঠিকঠাক বাকি কাজ সপ্তাহখানেকের মধ্যে শেষ করা হবে।’

সূত্র জানায়, ভবনটির নির্মাণকাজের চুক্তিমূল্য তিন কোটি ৮৭ লাখ ছয় হাজার টাকা। চুক্তি অনুযায়ী কাজ সমাপ্তির কথা ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। কলেজ নির্মাণকাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। নির্মাণকাজের প্রায় ৯৮ শতাংশ বিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উঠিয়ে নিয়েছে।

কয়েক মাস আগে কলেজের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে জানিয়ে মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘৯৮ শতাংশ টাকা ঠিকাদার তুলে নিলেও ১০ শতাংশ সিকিউরিটির টাকা আমাদের কাছে রয়েছে। অনেক টাকা রয়ে গেছে। কাজ শেষ করার পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আবার আসবেন, দেখবেন। তারপর তারা যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটা হবে। তবে আপাতত ঠিকাদারকে আমরা পে-মেন্ট করছি না।’

ফলস সিলিংয়ের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ওপরে প্রথমে অ্যাঙ্গেল থাকে, তারপর ফলস সিলিংগুলো বসানো থাকে। ওইদিকের চ্যানেলটার সাথে দরজাটা। দরজা ৮-৯ মাস ধরে ওভাবেই রাখা। কলেজ বন্ধ, এটা তো ব্যবহার করা হয় না। ব্যবহার না করার কারণে ওভাবেই রয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তেল-টেল দিয়ে কব্জাগুলো একটু নড়াচড়া করতে হয়। এগুলো করা হয়নি। চ্যানেলটা বাঁকা হওয়ায় কয়েকটা, দু-তিনটা ফলস সিলিং পড়ে যায়। সেগুলো ঠিক করে দিয়েছি।’

মুন্সিগঞ্জের অন্য প্রকল্পের হাল-হকিকত
আইএমইডির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৩ ও ১৪ নভেম্বর মুন্সিগঞ্জে বাস্তবায়নাধীন প্রায় ১২টি প্রকল্প পরিদর্শন করেন আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী।

‘দেশের ১৫৬টি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা সদর/স্থানে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় সিরাজদিখান ফায়ার স্টেশন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আইএমইডি সচিব পরিদর্শনে দেখেন, নির্মাণাধীন ভবনের সামনে রাখা ইটের মান ভালো নয়। সেখানে উপস্থিত গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, ওই ইট বাদ দিয়ে ভালো ইট দেয়া হবে। একই প্রকল্পের আওতায় টঙ্গিবাড়ি ফায়ার স্টেশন ভবনের নির্মাণকাজও চলছে। পরিদর্শনে দেখা যায়, এই নির্মাণাধীন ভবনের সামনে রাখা ইটের মানও ভালো নয়।’

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘দেশের গুরুত্বপূর্ণ ২৫টি (সংশোধিত ৪৬টি) উপজেলা সদর/স্থানে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন স্থাপন’ শীর্ষক আরেক প্রকল্পের আওতায় মুন্সিগঞ্জ সদর ফায়ার স্টেশন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এখানে পরিদর্শন শেষে ইটের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি আইএমইডি সচিব।

এতে উল্লেখ করা হয়, ‘বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় খাল-জলাশয় ও নদী পুনঃখনন (প্রথম পর্যায়)’ প্রকল্পের আওতায় সিরাজদিখানের নিমতলা-ইমামগঞ্জ-বাসাইল খাল খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে এ প্রকল্পে দেখা যায়, ৬ কিলোমিটার সংস্থান করা অংশের মধ্যে ৫ দশমিক ৭০ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন করা হয়েছে। বাকি দশমিক ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য পদ্মা বহুমুখী সেতু ও রেল সংযোগের কারণে পুনঃখনন করা হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভাষ্যমতে, খালের দক্ষিণ পাশে সড়ক ও জনপথ বিভাগের গাইডওয়াল এবং উত্তর পাশে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির কারণে খালটি পুনঃখননের প্রকৃত প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয়ের অভাব ছিল।

‘বৃহত্তর ঢাকা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩’ এর আওতায় সিরাজদিখান উপজেলার শেখেরচর এলাকায় ইছামতি খালের ওপর কেয়াইন ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। পরিদর্শনে দেখা যায়, তিন কোটি ৮০ লাখ ৫২ হাজার ১৫৪ টাকা চুক্তিমূল্যে ব্রিজটির নির্মাণকাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ব্রিজের অ্যাপ্রোচ সড়ক এখনো নির্মাণ করা হয়নি। যদিও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৮০ শতাংশ বিল তুলে নিয়েছে।

বৃহত্তর ঢাকা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় উপজেলাটির বেতকা নতুন বাজার থেকে অতুশাহী রাস্তা উন্নয়নের দেড় কিলোমিটারের পুরো কাজই সম্পন্ন হয়েছে বলে পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘বন্যা দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পল্লী সড়ক অবকাঠামো পুনর্বাসন’ প্রকল্পের আওতায় ভিপুর-পাঁচগাঁও-হাসাইল রাস্তার নির্মাণকাজের মান আপাতদৃষ্টিতে ভালো হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন আইএমইডি সচিব।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘সরকারি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজসমূহের উন্নয়ন (দ্বিতীয় সংশোধন)’ প্রকল্পের আওতায় হরগঙ্গা কলেজের মান্নোনয়নের কাজ চলছে। পরিদর্শনে দেখা যায়, ১০তলা ভবনের নির্মাণকাজ খুবই ধীরগতিতে হচ্ছে। বর্তমানে কেবল দ্বিতীয় তলার কাজ হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী কাজটি চলতি বছরের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পটির শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে, শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। ১০ বছরেও কাজটি শেষ করতে না পারার বিষয়টি দুঃখজনক। এ বিষয়ে যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যাও পায়নি আইএমইডি।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার চর কেওয়ার ইউনিয়নের জাজিরা-কাচারিঘাট নদীর ওপর চার কোটি ৭০ লাখ ৬৮ হাজার ৬২০ টাকা খরচে ৭৫ মিটারের বর্ষার চর ব্রিজ নির্মাণ শেষ হয়েছে। সদর থেকে বর্ষার চর ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওই রাস্তা সংলগ্ন এলাকায় খুব ভালো শাকসবজি উৎপাদন হয়। কিন্তু রাস্তাটি ভালো না হওয়ায় লোকজনের যাতায়াতে খুব অসুবিধা হচ্ছে এবং তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। ওই রাস্তায় ছোট ছোট আরও দু-একটি ব্রিজ রয়েছে। ব্রিজগুলো সরু প্রকৃতির ও রেলিং ভেঙে গেছে। যাতায়াতে ঝুঁকি আছে। রাস্তাটি সংস্কার/মেরামত না করা হলে নির্মিত ব্রিজটির ফল সেভাবে আসবে না বলেও মত দিয়েছে আইএমইডি।

‘বাংলাদেশের জেলা ও উপজেলায় ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামি কালচারাল সেন্টার স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পে মুন্সিগঞ্জ সদর, সিরাজদিখান, টঙ্গিবাড়ি, শ্রীনগর, গজারিয়া ও লৌহজং উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণের সংস্থান রাখা হয়েছে। এর মধ্যে কেবল টঙ্গিবাড়ি উপজেলার কাজ কিছুটা দৃশ্যমান হয়েছে। বাকি কাজগুলোর অগ্রগতি নেই বললেই চলে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালকের কর্মতৎপরতার অভাব রয়েছে বলেও আইএমইডির পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় খাল-জলাশয় ও নদী পুনঃখনন (প্রথম পর্যায়)’ প্রকল্পের আওতায় মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার কাটাখালী খালটি পুনঃখনন করার কথা। কিন্তু এটি এখনো পুনঃখনন করা হয়নি। খালটি পুনঃখননের মাধ্যমে দৃষ্টিনন্দন করে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য জেলা প্রশাসককে নেতৃত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইএমইডি।

এসব প্রকল্প পরিদর্শন শেষে আইএমইডি সচিব গত ১৬ নভেম্বর মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদারের সভাপতিত্বে প্রকল্প পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

এ বিষয়ে মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, ‘আইএমইডি সচিব যে অবজারভেশন দিয়েছেন, সেগুলো এখনো পাইনি। পাওয়ার পরে আইএমইডির অবজারভেশনগুলো দেখে মুন্সিগঞ্জের সংশ্লিষ্ট দফতর সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।’