নতুন ধারার উড়োজাহাজের এক কারিগর

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

এখন কী করছেন? ই-মেইলে প্রশ্নটা ছিল দেবযানী ঘোষের গবেষণা আর পড়াশোনার ব্যাপারে। ফিরতি মেইলে চলে এল উত্তর, ‘এখন আমি জিরো এমিসন (কার্বন নিঃসরণমুক্ত) বৈদ্যুতিক উড়োজাহাজের সম্পূর্ণ নতুন একটি হাইব্রিড সিস্টেম তৈরি করছি। সেই সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের এইচওয়াই-৪ উড়োজাহাজের বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছি।’ এ ছাড়া দেবযানী এখন জার্মানির উলম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিভার্সিটিতে পাওয়ার ইলেকট্রনিকস বিষয়ে ক্লাসও নিয়ে থাকেন।

২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দিনটি ফিরে দেখা যাক। দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে দেবযানীর জন্য। আবার বিশ্বের বেসামরিক বিমান চলাচল ইতিহাসেও একটি অনন্য দিন। জার্মানির স্টুটগার্ট বিমানবন্দরে চার আসনের যাত্রীবাহী বিমান এইচওয়াই-৪ সফলভাবে সেদিন উড়াল দেয়। এটি হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম কার্বন নিঃসরণমুক্ত বিমান। চলবে জ্বালানি কোষ ও ব্যাটারির সাহায্যে। চট্টগ্রামের মেয়ে দেবযানী ঘোষ এইচওয়াই-৪ উড়োজাহাজ তৈরিতে জড়িত। কার্বন নিঃসরণমুক্ত এই উড়োজাহাজ তৈরির বৈজ্ঞানিক অংশটির নেতৃত্বে আছে জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার (ডিএলআর)। গবেষণার প্রধান অংশীদার ইউনিভার্সিটি অব উলম। এই ইউনিভার্সিটি অব উলমের গবেষণা দলে পিএইচডি গবেষক হিসেবে কাজ করছেন দেবযানী ঘোষ।

দেবযানী বলছিলেন, ‘নতুন কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার উপযোগী করতে দীর্ঘ গবেষণা লাগে। গবেষণায় সফলতা এলে আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখন আমরা এইচওয়াই-৪ বিমান নিয়ে সে কাজটাই করছি। বাণিজ্যিক ফ্লাইটের উপযোগী কার্বন নিঃসরণমুক্ত উড়োজাহাজ নির্মাণের কাজ চলছে এখন।’ বললেন দেবযানী।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, দেবযানী এইচওয়াই-৪ উড়োজাহাজের বৈদ্যুতিক ইঞ্জিন নিয়ে গবেষণা করছেন। বই পড়তে ভালোবাসেন তিনি। তাই তো প্রতিদিন কিছুটা সময় বের করে চেষ্টা করেন বই পড়তে। ছবি আঁকতেও পছন্দ করেন।

আরও বড় এক কাজের সঙ্গে জড়িত দেবযানী। বেশ কয়েক বছর থেকে জার্মান প্রবাসে (www. germanprobashe. com) নামের একটা ওয়েব পোর্টাল চালাচ্ছেন। কেমন চলছে? দেবযানী বললেন, ‘অত্যন্ত ভালো। প্রতি মাসে ৫০ হাজারের বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আমাদের ওয়েবসাইট থেকে বিভিন্ন তথ্য জানতে পারছেন। একজন শিক্ষার্থী জার্মানিতে পড়তে আসার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেবেন, তা এখান থেকে জানা যায়। পাশাপাশি কোর্স বা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন, আবেদন প্রক্রিয়া, ভিসার জন্য সাক্ষাৎকার, আসার পর করণীয় কাজ, শিক্ষার্থীদের জন্য চাকরি খোঁজা ইত্যাদি অ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত সব তথ্যই আছে জার্মান প্রবাসে ওয়েবসাইটে।’ এর বাইরেও এই সাইটে জার্মানিতে থাকা প্রবাসী বাঙালিদের জন্যও রয়েছে জীবনযাপনের জন্য দরকারি নানা তথ্য। কোথায় কী জিনিস কেনা যায়, ড্রাইভিং লাইসেন্স, বিমা, দেশে টাকা পাঠানো, ঘোরাঘুরি, চাকরি খোঁজা, ব্লু কার্ড ইত্যাদি বিষয়ে নিবন্ধ থাকে জার্মান প্রবাসেতে। দেবযানী জানালেন, এই ওয়েবসাইটের বেশির ভাগ লেখকই জার্মানপ্রবাসী।

এইচওয়াই-৪ হাইব্রিড বৈদ্যুতিক উড়োজাহাজ বর্তমানে কী অবস্থায় রয়েছে? দেবযানী বললেন, এইচওয়াই-৪-এর প্রাথমিক সফল উড্ডয়ন ছিল গোটা কাজের শুরু। এরপর বিশ্বের অনেক প্রযুক্তি সম্মেলন ও মেলায় উড়োজাহাজটি দেখানো হয়েছে। যোগ করলেন, ‘এ মুহূর্তে একটা ইউরোপীয় প্রকল্প এবং জার্মানির একটা জাতীয় প্রকল্পের অধীনে আমরা এরপরের প্রজন্ম নিয়ে কাজ করছি।’

এখনকার কাজ নিয়ে আরও কিছু তথ্য দেন দেবযানী। ইউরোপীয় প্রজেক্ট মাহেপাতে (mahepa. eu) বিশ্বে প্রথমবারের মতো একই সঙ্গে দুই ধরনের সিরিয়াল হাইব্রিড পাওয়ারট্রেনের উড্ডয়ন পরীক্ষা করা হবে। এই দুটি হলো জ্বালানি কোষচালিত এইচওয়াই-৪ এবং বিকল্প জ্বালানিচালিত প্যান্থেরা।  প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ভবিষ্যতে কার্বন নিঃসরণমুক্ত (এমিসন ফ্রি) উড়োজাহাজ বাজারজাত করার প্রযুক্তি ও রোডম্যাপ তৈরি করা। প্রকল্পের সদস্য দেবযানী বলেন, ‘২০২০ সালে প্রথমবারের মতো এই দুটি উড়োজাহাজের উড্ডয়ন পরীক্ষা করা হবে।’

এইওয়াই-৪ বিমানের বর্তমান পর্যায়ে শক্তির ব্যবস্থাপনা (পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) নিয়ে কাজ করেন দেবযানী। এই ব্যবস্থার প্রধান কাজ হলো উড়োজাহাজের বিভিন্ন ধাপের চাহিদা অনুযায়ী এক বা একাধিক জ্বালানি উৎস নির্বাচন করা এবং প্রপেলারে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করা। এটি বিমানের অন্যতম কেন্দ্রীয় অংশ। যেটি বিমানের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ অংশকে সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণ করবে। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে বিমান যাতে নিরাপদে অবতরণ করতে পারে, তা নিশ্চিত করবে। প্রচলিত প্রযুক্তির বাইরে নতুন একটি হাইব্রিড ব্যবস্থা উন্নয়নের চেষ্টা করছেন দেবযানী।

এই তরুণ বিজ্ঞানীর জন্ম ১৯৮৮ সালের ৩০ অক্টোবর। দুই বোনের মধ্যে দেবযানী বড়। দেবযানী চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশলে স্নাতক হওয়ার কিছুদিন পর চলে যান জার্মানি। পিএইচডি করছেন সেখানকার ইউনিভার্সিটি অব উলমে। দেবযানীর বাবা দীপক কুমার ঘোষ এবং মা ইন্দিরা ঘোষ দুজনই শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দেবযানী বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে গেলে বাংলাদেশে মৌলিক গবেষণা বেশ কম হয়। তবে ইদানীং এই ধারার পরিবর্তন হচ্ছে। মেয়েদের অংশগ্রহণও বাড়ছে।’

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মূলধারার গবেষণায় বাংলাদেশের নামকে উজ্জ্বল করতে চান দেবযানী ঘোষ। ‘আমরা জানাতে চাই বাংলাদেশ শুধু বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের দেশ নয়, বরং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাম্প্রতিকতম উদ্ভাবনেও এ দেশের ভূমিকা রয়েছে।’