নজরুল জন্মজয়ন্তী নানা আয়োজনে প্রেম ও দ্রোহের কবিকে স্মরণ

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

বাঙালির অস্তিত্বে মিশে থাকা কবির নাম কাজী নজরুল ইসলাম। আমাদের এ জাতীয় কবির ১১৯তম জন্মজয়ন্তী ছিল শুক্রবার। গরম আর বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয়েছে তাকে। সকালে কবির সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ আর নজরুলের সৃষ্টির ছোঁয়ার সর্বস্তরের মানুষ স্মরণ করে প্রেম ও দ্রোহের কবিকে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আয়োজন করা নানা অনুষ্ঠানের।

নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজন করে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের। গতকাল বিকেলে কবির স্মৃতিধন্য ময়মনসিংহের ত্রিশালে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এছাড়াও কবির স্মৃতিধণ্য কুমিল্লা ও চট্টগ্রামেও আয়োজন ছিল নজরুল-জয়ন্তীর অনুষ্ঠানের।

ত্রিশালে তিনদিনের অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন 

কবির বাল্যস্মৃতি বিজড়িত ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুর নজরুল মঞ্চে জাতীয় পর্যায়ে তিন দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

এ সময় তিনি বলেন, বাংলা সাহিত্য-সংগীতের অন্যতম পথিকৃত যুগস্রষ্টা জাতীয় জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার কালজয়ী প্রতিভা ও জীবন দর্শন, মানবিক মূল্যবোধের স্ম্ফূরণ, সমৃদ্ধশালী লেখনী বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। নজরুল শুধু বাংলার জাতীয় কবিই নন, তিনি জাগরণের কবি, সাম্যের কবি। তিনি শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার, কুসংস্কার ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে তার লেখনীতে তুলে ধরেছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, আমাদের জাতীয় সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নজরুলের লেখনী আমাদের উজ্জীবিত করেছে। তার জাতীয়তাবোধ বাঙালির অনন্ত প্রেরণার উৎস। পরাধীন ব্রিটিশ আমলে সকল ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে তিনি বাংলা ও বাঙালির জয়গান গেয়েছেন।

অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, অতিরিক্ত সচিব এম মসিউর রহমান ও ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস বক্তৃতা করেন। সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সিমিন হোসেন রিমি এমপি। এরপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়।

এর আগে বিদ্রোহী কবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বর্ণাঢ্য শোভা যাত্রা বের হয়।

কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা

ভোর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে জাতীয় কবির সমাধিসৌধে নামে সর্বস্তরের মানুষের ঢল। কবি পরিবারের পক্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন তার ছেলে সব্যসাচী কাজীর স্ত্রী উমা কাজী, কবির দৌহিত্র দুর্জয় কাজী ও জয়া কাজী।

উমা কাজী বলেন, এ দেশ, বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে কাজী নজরুল ইসলামও ততোদিন অমর হয়ে থাকবেন। কবি নজরুল তরুণদের মধ্যে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। নজরুল তার কবিতা-গানে দেশের কথা বলেছেন, সাম্যের কথা বলেছেন। কবিকে জানতে হলে তার কবিতাকে জানতে হবে, তার লেখা পড়তে হবে। বিভিন্ন ভাষায় কবির লেখা ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান উমা কাজি।

কবির সমাধিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, বিএনপির পক্ষে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে রেজিস্ট্রার মো. কামাল উদ্দিন, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, জাকের পার্টিসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন কবির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন।

জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, কাজী নজরুল ইসলামকে এদেশে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাকে নাগরিকত্বও দিয়েছিলেন তিনি। কবি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সবসময় জয়গান গেয়েছেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নজরুল প্রাসঙ্গিক। জাতীয় কবি আমাদের শিখিয়েছেন বিদ্রোহ, শিখিয়েছেন সাম্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগ

কবির সমাধিসৌধের পাশে স্মরণসভার আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগ। ‘জাতীয় জাগরণে কবি নজরুল’ বিষয়ের ওপর আলোচনা করেন বেগম আখতার কামাল, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ সামাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক সৌমিত্র শেখর প্রমুখ। স্মরণসভার সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. কামাল উদ্দিন।

সৌমিত্র শেখর বলেন, জাতীয় জাগরণে কাজী নজরুল ইসলামের উপযোগিতা ছিল সব সময়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শক্তি জুগিয়েছেন। তিনিই প্রথম ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন।

স্মরণসভায় বিভাগের চেয়ারপারসন লীনা তাপসী খানের নেতৃত্বে ঢাবির সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থীরা গেয়ে শোনান ‘আলল্গাহতে যার পূর্ণ ইমান, কোথা সে মুসলমান’, ‘দাও শৌর্য, দাও ধৈর্য’, ‘ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায়/ টেনে নে না তারে কোলে’, ‘আয় মরু পারের হাওয়া নিয়ে যারে’সহ আরও বেশ কিছু গান।

শিল্পকলা একাডেমি

নজরুল জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে শুক্রবার শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। একাডেমির জাতীয় সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে আলোচনা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হোসনে আরা জলি।

আলোচনা শেষে সাংস্কৃতিক পর্বে ছন্দা চক্রবর্তী গেয়ে শোনান ‘নিশি ভোর হলো জাগিয়া’, রওশন আরা সোমা ‘কার নিকুঞ্জে রাত কাটায়ে আসলে’, শামীমা পারভীন শিমু ‘বল রাঙা হংশদ্যুতি’, সুমন চৌধুরী ‘রুমুঝুম রুমুঝুম কে বাজায়’, জান্নাতুল ফেরদৌস লাকী ‘নয়ন ভরা জলগো তোমার’ ও ‘তাওহীদের-এ মুর্শিদ আমার মুহাম্মদের নাম’, নাহিয়ান দূর্দানা শুচি ‘রুমঝুম রুমঝুম আসিলো রে প্রিয়’, মাহমুদুল হাসান ‘প্রিয়া গেছে কবে পরদেশ’ এবং শহীদ কবির পলাশ পরিবেশন করেন ‘শাওন আসিল ফিরে’। আবৃত্তি করেন শিল্পী মিজানুর রহমান সজল, লায়লা আফরোজ, রফিকুল ইসলাম, আশরাফুল আলম ও শিরিন ইসলাম।