কলেজছাত্রী আঁখি আক্তার নিখোঁজ হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠা দেখা গিয়েছিল মামাতো ভাই তরিকুল ইসলাম রায়হানের মধ্যে। আঁখিকে সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজা, থানা-পুলিশ-হাসপাতালে ছোটাছুটি, লাশ উদ্ধারের পর কান্নাকাটি ও দাফনে পরিবারে সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন তরিকুল। পুলিশ এখন বলছে, এসবই ছিল ‘ভান’। খুনটা আসলে তিনিই করেছেন। এই মামলার বাদী তরিকুলের বাবা মো. নুরুল ইসলাম। রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াছিন ফারুক মজুমদার গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, আঁখিকে হত্যার পর হাতে সেলাই করা যে কাঁথা দিয়ে মৃতদেহ প্যাঁচানো হয়েছিল, সেই কাঁথার সূত্র ধরেই পুলিশ হত্যাকারীকে খুঁজে পায়।
গত শনিবার বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে ঢোকার মুখে একটি কালো ব্যাগে কাঁথা দিয়ে প্যাঁচানো অবস্থায় আঁখি আক্তারের মৃতদেহ পাওয়া যায়। আঁখির বাবা মো. আরিফ হোসেন ও মা হাসনা হেনা দুজনেই মরিশাসে তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। পল্লবীর শহীদ জিয়া ডিগ্রি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আঁখি থাকত তার মামা মো. রোকন খানের বাসায়। স্ত্রী–সন্তানসহ মামাতো ভাই তরিকুল ইসলাম রায়হান একই বাসায় থাকতেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তরিকুল বলেছেন, আঁখিকে তিনি ধর্ষণ করেছিলেন। আঁখি এ কথা সবাইকে বলে দেওয়ার হুমকি দিলে তাকে গলাটিপে হত্যা করেন।
রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াছিন ফারুক মজুমদার বলেন, আঁখি নিখোঁজ হওয়ার পর তার মামা নুরুল ইসলাম পল্লবী থানায় নিখোঁজ হওয়ার ডায়েরি করেন। মৃতদেহ উদ্ধারের পর তিনি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় আঁখির বন্ধু সাব্বির, শান্ত ও ফোন-ফ্যাক্সের দোকানদার রায়হানকে আসামি করেন। আঁখির লাশ যেদিন উদ্ধার করা হয়, সেদিনই পুলিশ সাব্বিরকে আটক করে, পরে গ্রেপ্তার হয় রায়হানও। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শান্তকেও পুলিশ খুঁজছিল।
জানা যায়, তরিকুলের পরামর্শেই এঁদের তিনজনকে আসামি করা হয়। তিনি জানিয়েছিলেন, বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ একটা ফোন পেয়ে সে কলেজে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে যায়। ওই সময় তিনি ও আঁখি ছাড়া আর কেউ বাসায় ছিলেন না। মামলার বাদী নুরুল ইসলামও এর আগে প্রথম আলোকে বলেন, ১১টার সময় ফোনটা কে করেছে, মিলিয়ে দেখলেই খুনিকে পাওয়া যাবে। হত্যাকাণ্ডের পরও ফোনটা বেজেছিল। তখন সেটি কোথায় ছিল, তা–ও দেখা দরকার।
পুলিশ আঁখির মুঠোফোনে কথা বলার তালিকা মিলিয়ে দেখে, ওই দিন বেলা ১১টার দিকে আঁখির কোনো ফোন আসেনি। তার ব্যবহৃত দুটি ফোনে বন্ধু সাব্বিরের সঙ্গে আগের রাতের কথোপকথনের রেকর্ড আছে। মুঠোফোনটির অবস্থান ছিল মিরপুরে তার বাসা ও আশপাশে। আর উত্তরার ছেলে সাব্বির গোড়া থেকেই বলে এসেছে, সে খুনের সঙ্গে জড়িত নয়। সে-ই মরিশাসে আঁখির মা-বাবাকে নিখোঁজ থাকার কথা জানিয়েছে। পুলিশ এজাহারভুক্ত আসামিদের বাইরেও বাড়ির লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। তাঁদের দেখানো হয়, একটি কালো ট্রাভেল ব্যাগ, একটি বস্তা, একটি কাঁথা ও ওড়নার ছেঁড়া টুকরো। কাঁথাটা দেখেই আঁখির মামি জেসমিন ও তরিকুলের স্ত্রী হাসনা হেনা দুজনে বলে ওঠেন, ‘এই কাঁথা তো আঁখির’। আঁখির মামা মো. রোকন খান বলেন, আঁখি যেদিন নিখোঁজ হয়, সেদিন তরিকুল কালো ব্যাগ নিয়ে ছয়তলা থেকে নেমে আসছিলেন। ওই সময় তরিকুল খুব হাঁপাচ্ছিলেন। ভেতরে কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, জিনসের প্যান্ট আছে। বিক্রির জন্য নিচ্ছেন। কিন্তু তরিকুল কেন খুন করবে, তা-ই বুঝে উঠতে পারছিলেন না মো. রোকন খান। কারণ, ওই রকম একটি কালো ব্যাগ তিনি তাঁর লন্ড্রির দোকানেও দেখেছেন। সেখানে কয়েকটা জিনসের প্যান্টও ছিল।
অনুসন্ধানে পুলিশ জানতে পারে, আঁখির ফোনটি সাইদুর নামে মিরপুরের এক লোকের কাছে আছে। সাইদুরকে গ্রেপ্তারের পর তিনি জানান, এক ব্যক্তি এই ফোনটি তাঁর কাছে বিক্রি করেছেন। সাইদুর যাঁর বর্ণনা দেন, তাঁর সঙ্গে তরিকুলের মিল পাওয়া যায়। কিন্তু তরিকুল বৃহস্পতিবার ফুফু-ফুফাকে নিয়ে মাদারীপুরের কালকিনিতে যান আঁখির কবর জিয়ারত করতে। পুলিশ আঁখির ফুফাতো ভাই মো. শাহীন বাবুকে জানিয়ে দেয়, তরিকুলকে আটকাতে হবে। পরে তাঁকে আটক করে মাদারীপুরের পুলিশের হাতে দেওয়া হয়। ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদে খুনের কথা স্বীকার করেন তরিকুল।
তরিকুল পুলিশকে জানান, ঘটনার দুদিন আগে তাঁর স্ত্রী হাসনা হেনা বাপের বাড়ি যান। বাসায় তাঁর চাচা-চাচিও ছিলেন না। এই ফাঁকে তিনি মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের কথা আঁখি সবাইকে বলে দেওয়ার হুমকি দিলে তিনি গলাটিপে তাকে হত্যা করেন। গলা থেকে সোনার চেইন ও কানের দুল খুলে নেন। আঁখির ফোনও বন্ধ করে পকেটে রাখেন। এরপর মিরপুর ১১ নম্বর সোসাইটি মার্কেটে গিয়ে একটি কালো ব্যাগ ও তালা কেনেন। আঁখিকে কাঁথা দিয়ে জড়িয়ে ব্যাগে ভরেন। সেটা একটি সিএনজিতে করে নিয়ে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের কাছে চলে যান। কিন্তু নামার সময় দেখা যায়, ব্যাগের চেইন ছিঁড়ে গেছে। ধরা পড়ার ভয়ে ফুটপাতের এক ফলের দোকানিকে ব্যাগটা দেখে রাখার কথা বলে সটকে পড়েন। তারপর একই দোকান থেকে একই রকম আরেকটি ব্যাগ কিনে চাচার দোকানে রেখে যান। ফোনটা সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর পকেটে রাখেন। কিন্তু বন্ধ ফোনটা চালু করতেই ফোন আসতে শুরু করে। এরপর ফোনটা বন্ধ করে বিক্রি করে দেন। তারপর বোনের দাফন–কাফন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
পুলিশ বলছে, তরিকুলের উদ্দেশ্য ছিল ব্যাগটা কোনো একটা ট্রেনে তুলে দেওয়া। যাতে আঁখির বন্ধুর ওপর দায় চাপে। কিন্তু ব্যাগটি ফেটে যাওয়ায় সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আঁখির বাবা আরিফ হোসেন বলেন, ‘তরিকুল অন্যায় করেছিল, মাফ চাইতে পারত। তাই বলে আমার মেয়েটাকে খুন করল?’ সূত্র প্রথম আলো।