রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় বাড়ছে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজিসহ নানা কারণেই গত ১০ বছরে খুন হয়েছেন ১২ জন। এর বাইরে পারিবারিক কলহ, ছিনতাইকারীর গুলিতে বিকাশ এজেন্টসহ নিহত হয়েছেন আরও অর্ধডজন। সর্বশেষ গত বুধবার রাতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন ক্যাবল ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক ওরফে বাবু (২৭)। ঘটনার পরপরই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকরী বাহিনীর সদস্যদের তৎপর হয়ে উঠতে দেখা যায়। এমনকি এ ঘটনায় আসামি গ্রেফতার ও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সন্দেহভাজনদের নিহতের ঘটনাও ঘটে।
দক্ষিণ বাড্ডার জাগরণী ক্লাবে গুলিতে ক্যাবল অপারেটর বাবু হত্যাকাণ্ডের রাতেই তিনজনকে আটক করে পুলিশ। পরের দিন বৃহ্স্পতিবার (১০ মে) ভোররাতে ডিবি পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন সাফায়াত (৩০) নামে সন্দেহভাজন এক যুবক।
বাবু খুনের ঘটনায় পুলিশ জানায়, ডিশ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে ওই এলাকার সন্ত্রাসী একাধিক মামলার আসামি রবিন চেষ্টা করে আসছিলেন। রবিন মালয়েশিয়ায় অবস্থান নিয়ে বাড্ডা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। তারও ক্যাবল ব্যবসা (ডিশ) রয়েছে। তার লোকজন বাবুর ক্যাবল অপারেটর ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা চালায়। বিভিন্নভাবে এর নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হয়ে রবিন তার লোকজনকে দিয়ে রাজ্জাককে খুন করায়।
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল রাজধানীর বাড্ডার বেরাইদ এলাকায় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঢাকা-১১ আসনের এমপি ও বেরাইদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হন বেরাইদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলমের ভাই কামরুজ্জামান দুখু (৩৫)। তিনি রড-সিমেন্টের ব্যবসা করতেন।
এ ঘটনায় জাহাঙ্গীর আলমের দায়ের করা হত্যা মামলায় বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর হাকিম নুরুন্নাহার ইয়াসমিনের আদালত শুনানি শেষে গ্রেফতারকৃত তিন আসামি ফারুক আহম্মেদ, আইয়ুব আনসারী এবং মারুফ আহম্মেদকে তিনদিন করে রিমান্ডের আদেশ দেন। ফারুক আহম্মেদ আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য রহমত উল্লাহর ভাগ্নে।
বাড্ডায় বিভিন্ন সময় নিহতদের স্বজন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, বাড্ডা এলাকায় দখল, চাঁদাবাজি, মাদকব্যবসা, ঝুট ব্যবসা, গরুর হাটের ইজারা নিয়ে দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। ভাগ্নে গ্রুপ, ফারুক গ্রুপ, মেহেদী গ্রুপ, রায়হান গ্রুপ, ডালিম-রবিন গ্রুপ, জাহাঙ্গীর-আলমগীর গ্রুপ এবং অনিক গ্রুপ।
বাড্ডা থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি দুপুরে মেরুল বাড্ডায় মাছ ব্যবসায়ী আবুল বাশারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় জড়িত নুরুল ইসলাম নুরুকে (৩৫) হাতেনাতে জনতার সহযোগিতা আটক করা হয়। পরে রাতে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন তিনি।
বাড্ডা থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, মেরুল বাড্ডায় মাছের আড়তে বাদশা খুনের ঘটনায় তার স্ত্রী শিউলী আক্তার ডিবি পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত নুরু ছাড়াও আরিফ, জয় ও মাসুমকে আসামি করে মামলা করেন। এদের মধ্যে নুরু ও আরিফের বিরুদ্ধে গত ১৪ নভেম্বর বনানীর রিক্রুইটিং এজেন্সির মালিক সিদ্দিক মুন্সীকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। আরিফ বাড্ডায় এর আগে আরও বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে।
২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বরে বাড্ডার হোসেন মার্কেটের পেছনে একটি নির্মাণাধীন বাড়িতে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসীরা দুই নির্মাণ শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে। ওই ঘটনার দুইদিন পর মনির নামে সন্দেহভাজন একজন আসামি পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
২০০৯ সালের ১৮ নভেম্বর রাজধানীর মধ্যবাড্ডার জিপি-প-৮৮ নম্বর নিজ বাড়ির পেছনে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন ৯৭নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগ সভাপতি নাজিম (৩০)। এ সময় তার মামাত ভাই উজ্জ্বল গুলিবিদ্ধ হন।
পুলিশ জানায়, ভাইয়ের হত্যা মামলার সাক্ষী, গরুর হাটের ইজারা, ডিশ ও ঠিকাদার ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন গ্রুপের কিলাররা এ ঘটনা ঘটায়। নাজিমের কাছে চাঁদা দাবি করেছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন গ্রুপের ক্যাডার কাবিল ও হিরা। নাজিম হত্যার পর মেহেদী গ্রুপের অন্যতম ক্যাডার কাবিলা পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর বাড্ডা থানাধীন মেরুল বাড্ডা এলাকায় তৎকালীন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর ভাগ্নে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মামুনুর রহমান মামুনকে (৩৫) দিনের বেলায় গুলি ও বোমা ছুড়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে রাজু, নাসির, মাইনউদ্দিন, মাইনুল, সাইফুল ও মেহেদীকে আটক করে র্যাব। মামুন খুনে কিলারের ভূমিকায় ছিলেন আটক রাজু আহমেদ। এ ঘটনায় জাহাঙ্গীর-আলমগীরের গ্রুপের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে।
২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি আনন্দনগরে দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে মারা যান আমির হোসেন নামের একজন। ২০১৫ সালের ৩ মে বাড্ডা জাগরণী সংসদ ক্লাবে আফতাবনগর পশুর হাটের ৬০ লাখ টাকা চাঁদার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বৈঠক চলাকালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন বাড্ডা থানা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন রাহিন। একই বছরের ১৬ মে বাড্ডায় দুলাল হোসেন নামের এক পুলিশ সোর্সকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট রাতে বাড্ডার আদর্শনগর পানিরপাম্প এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান গামা, বাড্ডার ছয় নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শামসুদ্দিন মোল্লা, ব্যবসায়ী ফিরোজ আহমেদ মানিক ও যুবলীগ নেতা আবদুস সালাম।
এ ঘটনার পর নিহত গামার বাবা মতিউর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে আসামি করে বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে সাইদুল নামে এক যুবক পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। দায়ের করা মামলাটি পুনঃতদন্ত করছে সিআইডি।
মামলার বাদী অভিযোগ করেন, আফতাবনগর হাটের ইজারাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষ ভাগ্নে ফারুখ ও বিদেশে আত্মগোপনে থাকা মেহেদীর নির্দেশে তার ছেলেকে ভাড়াটে খুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। খুনের মিশনে অংশ নেন আরিফ, পবন, পুলক, রমজান, মানিক, মান্নানসহ ১০-১২ জন সন্ত্রাসী।
এর বাইরে ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর রাজধানীর মধ্যবাড্ডায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে জবাই করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। বাড়ির নিচের গোডাউন ভাড়ার নাম করে এসে তাকে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ উত্তর বাড্ডার কুমিল্লাপাড়ায় ছিনতাইকারীদের গুলিতে মো. মাহবুব (৩০) নামে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশের এক এজেন্ট নিহত হন।
গত বছরের ২ নভেম্বর উত্তর বাড্ডার ময়নারবাগের ৩০৬ পাঠান ভিলার তিনতলার ভাড়া বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় জামিল (৩৮) ও তার মেয়ে নুসরাতের মরদেহ। পরে পুলিশ জানায়, জোড়া খুনের ঘটনায় নিহতের স্ত্রী আরজিনার পরকীয়া প্রেমিক শাহিন মল্লিক জড়িত। ওই ঘটনায় আরজিনা ও শাহিন আদালতে দায় স্বীকার করে নেন।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে গুলশান বিভাগের বাড্ডা জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার আশরাফুল করিম বলেন, বাড্ডা, বেরাইদ, সাঁতারকুল ইউনিয়ন মিলে বড় একটি এলাকা বাড্ডা থানার অধীনে। অভিজাত এলাকায় কাজ করা নিম্নশ্রেণির মানুষের বসবাস বেশি বাড্ডায়। এখানে উঠতি কিছু উন্নয়নমূলক, আবাসন প্রকল্প হচ্ছে। মূলত এসব নিয়েই দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারে চেষ্টা চলে অপরাধীদের মধ্যে।
তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি গ্রুপও বিভিন্ন সময় সক্রিয় ছিল। তবে একেক সময় একেকটি ভেঙে ফেলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এবার মালয়েশিয়া থেকে রবিনের নির্দেশনায় খুন হলেন বাবু। এর সঙ্গে জড়িতদের আমরা ধরে ফেলেছি। এরপর আর কোনো গ্রুপ যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সে বিষয়টি আমরা কঠোরভাবে দেখছি।