ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে এখন শয্যাশায়ী স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় আব্দুল হাকিম। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে চিকিৎসা সঙ্কটে ভুগছেন যশোরের এ কৃতি সন্তান। অভাবে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করতে না পারায় জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধা ভাতা হিসেবে যে টাকা পান, তাতে কোনো রকমে সংসার চলে তার। তবে এতে চিকিৎসার খরচ চলছে না। এমনকি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ও বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় ফুটবল দলের লেফট উইং ব্যাক এ ফুটবলারের খোঁজও এখন আর কেউ রাখেন না বলে আক্ষেপ তার পরিবারের সদস্যদের।
শেখ মো. আব্দুল হাকিম যশোর উপশহর ‘এ’ ব্লকের বাড়িতে থাকেন। গত জানুয়ারি মাসে তিনি ব্রেন স্ট্রোক করেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডায়াবেটিকস। ব্রেন স্ট্রোকের কারণে তার একটি চোখের ৯০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। অসুস্থ হবার পর তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন কোলকাতা ও ঢাকায়।
আব্দুল হাকিমের স্ত্রী মোমেনা খাতুন জানান, এখন তাকে সবসময়ই ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয়। ঘুম ভাঙলেই মাথায় যন্ত্রণা করে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্তত ১০ লাখ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু এত টাকা আমাদের নেই।
যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, আব্দুল হাকিম ৭০ থেকে ৮০ দশকের দেশসেরা লেফট উইং ব্যাক ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের পক্ষে অংশ নিয়ে বিশ্বের দরবারে ক্রীড়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেন।
শেখ আব্দুল হাকিম ১৯৪৯ সালের ৪ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত কাজীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শরাফত আলী ও মাতা হাফিজা খাতুন। ১৯৭৬ সালে সাতক্ষীরার মোমেনা খাতুনকে বিয়ে করেন। এক ছেলে ও তিন কন্যা সন্তানের বাবা তিনি।
আব্দুল হাকিম ১৯৬৩ সালে যশোর উপশহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। শিক্ষা জীবনে ১৯৬৬ সালে যশোর মুসলিম একাডেমী থেকে এসএসসি ও ১৯৬৮ সালে যশোর এমএম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে ১৯৬৫ সালে যশোর মডেল হাই স্কুলের পক্ষে আন্তঃস্কুল খুলনা বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হন। ওই বছরই তিনি যশোর জেলা ফুটবল দলের পক্ষে খেলায় অংশ নেন। তিনি কর্মজীবনে ১৯৬৮ থেকে ফুটবল খেলোয়াড় সূত্রে খুলনা জুট মিলে পার্সেজ অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে ইস্ট পাকিস্তান যুব দলে যশোরের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে তিনি অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান।
১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় দলের পক্ষে অংশগ্রহণ করেন। তার খেলার মূল পজিসন ছিল রাইট ব্যাক। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে খেলেছেন লেফট ব্যাক হিসেবে। তিনি ১৯৬৮-৬৯ ঢাকা লীগের দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের পক্ষে অংশগ্রহণ করেন এবং তার দল রানার্স আপ হবার গৌরব অর্জন করে।
১৯৭০-৭৬ ইপিআইডিসি’তে (বর্তমান বিজেএমসি) যোগদান করেন। ওই সময় তিনি ঢাকায় অনুষ্ঠিত আগাখান গোল্ডকাপে অংশ নিয়ে বিদেশি দলসমূহের বিপক্ষে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৭২ সালে তিনি আসামের গৌহাটি বরদুলই শীল্ডে, ওই বছরে ঢাকা স্টেডিয়ামে কলকাতা মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল দলের বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭৭ সালে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স এবং ১৯৭৮ সালে ওয়ারী ক্লাবের পক্ষে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে কৃতিত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৩ এবং ১৯৭৫ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত মারদেকা আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন।
শেখ আব্দুল হাকিম মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের’ পক্ষে ভারতের এলাহাবাদ, বিহার, বেনারস, পাঞ্জাবসহ বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী ম্যাচে অংশ নিয়ে বিশ্বের দরবারে ক্রীড়ার মাধ্যমে দেশকে মহান স্বাধীনতার দাবিকে তুলে ধরেন। যশোর তথা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের গর্বিত সন্তান শেখ আব্দুল হাকিম তার সম্মাননা হিসেবে কেবলমাত্র ১৯৯৬ সালে যশোর চাঁদের হাট পদক পেয়েছেন।
শেখ আব্দুল হাকিমের ব্যাপারে সাবেক জাতীয় দলের ফুটবলার ও হকি খেলোয়াড় কাওছার আলী বলেন, ৭০ বছর বয়সে জীবন সায়াহ্নে এসে যশোর তথা দেশে গর্বিত সন্তান হাকিমের খোঁজ-খবর কেউ রাখে না। অর্থের অভাবে উন্নত চিকিৎসা হচ্ছে না জাতীয় এ বীরের। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় আব্দুল হাকিমের সুচিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন তার স্ত্রী মোমেনা খাতুন।