দেশের ক্রিকেট-স্থপতির চিরবিদায়

লেখক:
প্রকাশ: ৪ years ago

‘একে একে নিভিছে দেউটি।’ বাংলাদেশের ক্রিকেটের নেপথ্য কারিগর, রূপকার, স্থপতিরা একের পর এক বিদায় নিচ্ছেন। এই তো কয়েক মাস আগে চলে গেছেন দেশের ক্রিকেটের অন্তঃপ্রাণ সংগঠক রেজা ই করিম। আজ ২০ জানুয়ারি সকালে চিরবিদায় নিলেন দেশের ক্রিকেটের স্থপতি, স্বাধীনতার পর ক্রিকেটকে নতুনভাবে সংগঠিত করার অগ্রদূত রাইস উদ্দিন আহমেদ।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন রমরমা দিন। বিশ্ব ক্রিকেটে এখন বাংলাদেশ মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য, আভিজাত্য- যাই বলা হোক না কেন, বেড়েছে বহুগুণে। কিন্তু সেটা তো আর একদিনে হয়নি!

দেশের ক্রিকেট রাতারাতি আজকের অবস্থানে পৌঁছেনি। এখন দেশের ক্রীড়াঙ্গনই ক্রিকেটময়। ক্রিকেট বোর্ড ফেডারেশন হিসেবে এক নম্বরে। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, ঐশ্বর্য আর সমৃদ্ধি ধরলে বিসিবি এখন অনেক ‘ধনী।’ অথচ এক সময় মানে ৪০-৪৫ বছর আগের প্রেক্ষাপট আর পরিবেশ ছিল একদমই ভিন্ন।

ক্রিকেট ছিল হত দরিদ্র। নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। এখনকার খো-খো, রাগবি, ক্যারম ফেডারেশনের মত। আয় বলতে কিছুই ছিল না। সরকারের কাছ থেকে পাওয়া বাৎসরিক বরাদ্দটুকুই ছিল সম্বল। এখনকার বিশাল অট্টালিকা প্রাসাদতুল্য অফিস ছিল অলীক কল্পনা।

দেশের ক্রিকেট ব্যবস্থাপনায় কত লোকবল। কোটি কোটি টাকা বেতন গুনছেন বিসিবির স্টাফরা। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেশের ক্রিকেটের যখন যাত্রা শুরু হয়েছিল, তখনকার চিত্র ছিল নেহায়েত জরাজীর্ণ।

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে এক কক্ষ ভেঙে দুই রুমের অফিস। অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। ইলেকট্রিক বিল দিতে না পারায় বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেয়ার ঘটনাও আছে। আছে রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে বোর্ডের কর্মকাণ্ড পরিচালনার নজির।

ঠিক সেই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে ওই সময়ে যারা দেশের ক্রিকেটকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের পুরোধা ছিলেন রাইস উদ্দিন আহমেদ। ক্রিকেটকে দিয়েছিলেন আলোর সন্ধান। যাদের হাত ধরে সূচিত হয়েছিল দেশের ক্রিকেটের নতুন পথের যাত্রা, সেই দলের অন্যতম অগ্রদূত ছিলেন রাইস উদ্দিন।

প্রথম জীবনে ছিলেন ক্রিকেটার। রাজধানী ঢাকা তথা দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ সেন্ট গ্রেগরী স্কুল থেকে ১৯৫৪ সালে মাধ্যমিক পাশের পর কলেজ জীবনের শুরুতেই ঢাকা লিগ খেলতে শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তান মূল দলে না খেললেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে পাকিস্তানের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন পঞ্চাশ দশকের শেষ ভাগে। এর পর ঈগলেটসের হয়ে বেশ কয়েক বছর ঢাকা লিগ খেলেছেন সুনামের সাথে।

খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করতেই ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে শুরু হয় রাইস উদ্দিনের যাত্রা। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। তারপর মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিকেটের অগ্রযাত্রার অগ্রভাগে ছিলেন তিনি।

বিসিসিবির (প্রথম নাম ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড) প্রথম যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করে ১৯৭৫-৭৬ ‘এর দিকে দায়িত্ব নেন বিসিবির সাধারণ সম্পাদক পদে।

তখনই ক্রিকেটকে এগিয়ে নেয়ার দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন পূরণের চেষ্টায় হন ব্রত। তখনই অনুভবে ছিল, ক্রিকেটকে কিভাবে এগিয়ে নেয়া যায়। সবার আগে করেন ঘরোয়া ক্রিকেট চালুর চেষ্টা।

স্বাধীনতার পর ক্রিকেট চর্চায় খানিক বাধা-বিপত্তি চলে আসে। ক্রিকেটের সরঞ্জাম আনতে হতো বিদেশ থেকে। তাতে ছিল বিশাল অংকের শুল্ক। সেই শুল্ক মওকুফ করার কাজে যে হাতে ক’জন রেখেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা, তার অন্যতম ছিলেন রাইস উদ্দিন আহমেদ।

বিসিবির হয়ে বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসির সহযোগী সদস্য হবার আবেদন করেন তিনি। নিজে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের সদস্য ছিলেন বলে ৭০‘র মাঝামাঝি এমসিসিকে ঢাকায় আনার কাজটিও রাইস উদ্দিনই করেছিলেন। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশের আইসিসির সদস্যপদ লাভ আর প্রথম বিদেশি দল হিসেবে এমসিসিকে দেশে আনার কঠিনতম দুটি কাজেই ছিল তার হাতের ছোঁয়া।

যখন ক্রিকেট এদেশে কারো ভাবনার বস্তু ছিল না, ক্রিকেট নিয়ে উচ্চাশা যখন ভাবা হতো ‘গরীবের ঘোড়া রোগ’- ঠিক ঐ সময় রাইস উদ্দিন, মাজহারুল ইসলাম দামাল আর রেজা ই করিম ও আমিনুল হক মনিরা ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন।

দেশের ক্রিকেটের নবযাত্রার স্বপ্ন সারথি রাইস উদ্দিনের মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই শোকের ছায়া নেমে এসেছে। জাতীয় দলের দুই সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান আর গাজী আশরাফ হোসেন লিপুরা শোকে মুহ্যমান।

জাগো নিউজের সাথে আলাপে রাইস উদ্দিন সম্পর্কে স্মৃতিচারণি করতে গিয়ে রকিবুল হাসান বলেন, ‘আসলে রাইস ভাই ছিলেন দেশের ক্রিকেটের অন্যতম অভিভাবক। তার মৃত্যু মানে একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি।’

জাতীয় দলের আরেক সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর চোখে রাইস উদ্দিন আহমেদ ছিলেন দেশের ক্রিকেটের নিবেদিতপ্রাণ চরিত্র। লিপু জাগো নিউজকে জানান, ‘যে সময় ক্রিকেটে কোন ঐশ্বর্য, আভিজাত্য আর বিলাসিতা ছিল না, তখন প্রায় অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে রাইস ভাইরা ক্রিকেট উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেছেন। তার আসলে কিছু পাবার ছিল না। তিনি, রেজা ভাই (রেজা ই করিম) দামাল ভাই (মাজহারুল ইসলাম) ও মনি ভাইদের (আমিনুল হক মনি) মিলে শুধু ক্রিকেটের জন্যই কাজ করেছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এগিয়ে নিতে রেখেছেন কার্যকর অবদান।’

রাইসউদ্দীন আহমেদের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রকিবুল হাসান বলেন, ‘রাইস ভাই ছিলেন জাত সংগঠক। সেই পাকিস্তান আমল থেকে তিনি ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের সম্পাদক ছিলেন, দেশ স্বাধীন হবার পর সেই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ক্রিকেট উন্নয়নে ব্রত হন।’

রকিবুল আরও জানান, ‘রাইস ভাই বিমানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় দেশের ক্রিকেট উন্নয়নে বিমানকে সম্পৃক্ত করার কাজটিও করেন। অনেক ক্রিকেটারকে বিমানে চাকুরি দেয়ার ব্যবস্থা করেন।’

দেশের ক্রিকেটের সুলেখক বরেণ্য ক্রিকেট বোদ্ধা, বিশেষজ্ঞ ও প্রশিক্ষক জালাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘রাইস ভাই এমন এক সময় ক্রিকেটের অভিভাবক ছিলেন, যে সময়কে আর দেখানো যাবে না। তখন দেশের ক্রিকেটকে গড়ে তোলা সহজ কাজ ছিল না। রাইস ভাই সেই সময় দেশের ক্রিকেটকে সংগঠিত করেছিলেন।’

জালাল আহমেদ চৌধুরী যোগ করেন, ‘দেশের ক্রিকেটের তখন চরম দুর্দিন। টাকা পয়সা ছিল না একদমই। আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন বহুদূরে, ঘরোয়া ক্রিকেট পরিচালনা মানে লিগ খেলা চালানোই ছিল দায়, তখন রাইস উদ্দিনরা অনেক কষ্ট করে ধারদেনা করে আম্পায়ার ও স্কোরারদের অর্থ বরাদ্দের কাজ করেছেন।’

রকিবুল, জালাল আর লিপুই শুধু নন, দেশের ক্রিকেটের অনেক বিদগ্ধজনের মতে-রাইসউদ্দীন ছিলেন দেশের ক্রিকেটের স্থপতি। তার মতো এমন একজন ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে ফেলা বাংলাদেশের ক্রিকেটের অপূরণীয় এক ক্ষতি।