ধারাবাহিক দরপতন আর লেনদেন খরায় অনেকটাই নিষ্প্রাণ দেশের শেয়ারবাজার। সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য দেয়া বিশেষ সুবিধা এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে চীনের দুই প্রতিষ্ঠান শেনঝেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জেকে পাওয়ার মতো সুখবরও বাজারে প্রাণ ফিরছে না।
ক্রমগত শেয়ারের দরপতনে একটু একটু করে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি কমে আসছে। পুঁজি হারানোর শঙ্কার পাশাপাশি আস্থার সংকট জেঁকে বসেছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। ফলে হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে দেশের শেয়ারবাজারে।
কী কারণে শেয়ারবাজারের এমন চিত্র- তা নিয়ে পাঁচ পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথমটি।
কয়েক বছর ধরে দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের ব্যাংকিং খাত। মালিকদের অবৈধ হস্তক্ষেপ, আর্থিক কেলেঙ্কারি, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, অর্থসংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এ খাত। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের এ দুরবস্থা আরও প্রকট হয়েছে। সমস্যার সমাধানে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিশেষ সুবিধা দিলেও তার কোনো সুফল মিলছে না।
ব্যাংকগুলোর সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন ও লভ্যাংশ এবং প্রান্তিক প্রতিবেদনেও এ তথ্য উঠে এসেছে। তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ২০১৭ সালের সমাপ্ত বছরে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২৮টি ব্যাংক। আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে এবার লভ্যাংশ না দেয়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে এবি ব্যাংক।
লভ্যাংশ দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শুধু বোনাস শেয়ার দেয়ার তালিকায় এবার এমন ১০টি ব্যাংক রয়েছে যারা আগের বছর শুধু নগদ অথবা নগদ ও বোনাস উভয় লভ্যাংশ হিসেবে দিয়েছিল। এছাড়া নগদ লভ্যাংশ দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পাঁচটি এবার গত বছরের তুলনা কম নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। গত বছরের ধারাবাহিকতায় এবার দু’টি ব্যাংক শুধু বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে দিলেও পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে।
শুধু লভ্যাংশের চিত্রে নয় ২০১৮ সালের প্রথম প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদনও ব্যাংক খাতের দুরবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর মুনাফায় রীতিমত ধস নেমেছে। তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ২৯টি ব্যাংক প্রথম প্রান্তিকের আর্থিক হিসাব প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ১৭টির শেয়ারপ্রতি মুনাফা আগের বছরের তুলনায় কমেছে। দু’টি ব্যাংক লোকসানে রয়েছে।
এদিকে বরাবরের মতো খেলাপি ঋণেও জর্জরিত অবস্থায় রয়েছে ব্যাংক খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালের শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। ২০১৭ সাল শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকায়। অর্থাৎ ছয় বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫১ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা।
ব্যাংক খাতের এমন চিত্র প্রকাশের পর থেকে দেশের শেয়ারবাজারে প্রায় প্রতিদিন লেনদেন হওয়া সিংহভাগ ব্যাংকের শেয়ারের দাম কমছে। আর ব্যাংক খাতের পতনের কারণে টানা দরপতনের মধ্যে পড়েছে শেয়ারবাজার। ২০ মে পর্যন্ত টানা ১৩ কার্যদিবস পতন হয়েছে। এতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৪২৩ পয়েন্ট।
ব্যাংক খাতের দুরবস্থা শেয়ারবাজারের টানা দরপতনের একটি কারণ উল্লেখ করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংক খাতের সমস্যার খুব একটা সুরাহা হয়নি। ব্যাংক জালিয়াতি, ঋণ আদায় পরিস্থিতি, তারল্য পরিস্থিতি নিয়ে সমস্যা রয়েছে। এছাড়া বেশকিছু ব্যাংক এবার কম লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব শেয়ারবাজারে দেখা যাচ্ছে। কারণ ব্যাংক খাত বাজার মূলধনের একটি বড় অংশ।’
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক বলেন, ‘বাজারে যে টানা দরপতন দেখা দিয়েছে, এর মূল কারণ ব্যাংক ও আর্থিক খাতের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশিত লভ্যাংশ দিতে পারেনি। ফলে বাজারে এক ধরনের তারল্য সংকটও দেখা দিয়েছে। এ তারল্য সংকটের কারণে টানা পতন দেখা দিয়েছে।’
ডিএসইর সাবেক পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, “ব্যাংকের তারল্য সংকটের কারণে সুদের হার বেড়ে গেছে। সুদের হার বাড়ার কারণে শেয়ারবাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ব্যাংকগুলো এবার বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দেয়নি। এবি ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান ‘নো ডিভিডেন্ট’ ঘোষণা করেছে। এসব বিষয় বাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ কারণেই টানা দরপতন দেখা দিয়েছে।”
ডিএসইর সাবেক পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন বলেন, ‘ব্যাংকগুলো প্রচণ্ড তারল্য সংকটে রয়েছে। এর প্রভাব বাজারে দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক হঠাৎ হঠাৎ পলিসি পরিবর্তন করে। কিন্তু শেয়ারবাজারে এর কী প্রভাব পড়বে তা চিন্তা করে না। যেমন- ঋণ আমানত অনুপাত (এডি রেশিও) একবার কমালো, আবার বাড়ালো।’
‘শেয়ারবাজার একটি সেনসেটিভ জায়গা। সবকিছুর প্রভাব এখানে পড়ে। ব্যাংকগুলোতে প্রচণ্ড সুসাশনের অভাব রয়েছে, যে কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।’