বৈশ্বিক মহামারি, নতুন অভিজ্ঞতা, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা, স্তব্ধ সময়ের বিমূঢ়তা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। চলমান করোনাভাইরাসের আতঙ্কের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় নিরতিশয় দুর্দশা। পেশার প্রতি কমিটেড সম্মুখযোদ্ধা ব্যতিত সবক্ষেত্রেই অস্থির-অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকারি নানামাত্রিক পদক্ষেপ, কঠোর নিয়মনীতিকে ছাপিয়ে স্বাভাবিক সেবায় কোনো সুলক্ষণ চোখে পড়ছে না। ভুক্তভোগীরা প্রতিনিয়ত হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে দুর্ভোগের শিকার তো হচ্ছেনই উপরন্ত সেবাগ্রহীতার একটা অসহায় অংশ সেবাবঞ্চিত হয়ে অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। প্রিয় মুখগুলোর এমন অসহায়ভাবে ঝরে পড়তে দেখে হতবিহ্বল স্বজনেরাও নির্বাক পাথুরে মূর্তির মতোন স্তব্ধ বনে যাচ্ছেন।
দেশের হাসপাতাল ক্লিনিকগুলোতে অপেক্ষমান রোগী-রোগীর স্বজন; কান্না-আহাজারি-ব্যস্ত ছোটাছুটি, নমুনা সংগ্রহে-শনাক্তে চরম অব্যবস্থাপনা অক্সিজেন বাণিজ্য, আইসিইউ, ভেনটিলেটর-শয্যা ব্যবস্থাপনাসহ সারাদেশে ল্যাব-কিট-জনবল স্বল্পতা সবকিছু মিলিয়ে দমবন্ধকর-আর্তনাদ-আর্তচিৎকারে হ য ব র ল অবস্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরলস পরিশ্রম, আন্তরিক সদিচ্ছা, মানবিক দায়বদ্ধতা দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ রেখে মহামারি মোকাবেলা করার সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ সত্বেও চলছে সমন্বয়হীনতার সংস্কৃতি— এমন মহাদুর্যোগে সব মানুষের উচিত পরিপূর্ণ মানবিকতা নিয়ে যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী দল মত নির্বিশেষে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর।
একদিকে বেড়েই চলেছে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার। বাংলাদেশে দুই হাজার ছাড়ালো মৃতের সংখ্যা, স্বাস্থ্য বুলেটিনে প্রকাশ (০৫.০৭.২০২০) তারিখে দেশে মোট মৃত্যু সংখ্যা দুই হাজার ৫৫ জন। অথচ এর আগের দিনের মৃতের সংখ্যা কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক ছিলো। যদিও সব মৃত্যুই বেদনার, সব মৃত্যুই দীর্ঘশ্বাসের। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রে হু হু করে বেড়েই চলেছে আক্রান্ত এবং মৃত্যুহার; দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যায় নিত্য নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। প্রতিবেশি দেশ ভারতেও আশঙ্কাজনক হারে ভাইরাসটির বিস্তার এবং প্রাণহানি সমান তালে উর্ধ্বমুখী গতিতে ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে। তবুও থেমে নেই সীমান্ত উত্তেজনা। বড়ো বিস্ময় জাগে মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়েও পৃথিবীতে সমরাস্ত্র, রণতরী যুদ্ধংদেহি অসুস্থ মানসিকতার নিষ্ফল আস্ফালনের বাড়াবাড়ি। বিশ্ব মানবিকতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। নেতৃবৃন্দের এহেন ঔদ্ধত্যপূর্ণ দম্ভ-অহমিকার দাপটে পুরো পৃথিবী স্তম্ভিত। সভ্যতার স্মারক মানবজাতি ক্রমেই হেরে চলেছে সূক্ষ্ম এক অণুজীব-ভাইরাস কভিডের দুর্দন্ড প্রতাপের কাছে; এখনও নেই কোনো কার্যকরী প্রতিষেধকের নবতর আলো, সেখানে বিশ্ব শাসকদের এমন অহেতুক শক্তির মহড়া, সাম্রাজ্য দখলের ঠুনকো অপকৌশলকে বড়ো বেমানান মনে হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ড. টেড্রস অ্যাডহানম গেব্রেইয়েসুস শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, করোনা মহামারি থামেনি এখনও; ভাইরাস নির্মূল হওয়ারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উপসর্গহীনদের সংখ্যা সনাক্ত করা যাচ্ছে না সুতরাং এ ভাইরাস অনেক দূর যেতে পারে। ইমিউনিটি নিয়েও চলছে বৈজ্ঞানিক-অবৈজ্ঞানিক নানামাত্রিক আলোচনা। ইমিউন শব্দটির মেডিকেল অর্থ হচ্ছে প্রতিরক্ষা, মানবদেহে এই ইমিউন সিস্টেম নামে খুব সংবেদনশীল এবং উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিরক্ষা পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতি খুব দ্রুত সব ধরণের ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস এবং অন্যান্য জীবানুকে শনাক্ত এবং ধ্বংস করে দিতে পারে। রক্তের শ্বেত কণিকা ( WBC…White Blood Cell) র মাধ্যমে সে এই কাজটি করে থাকে। গবেষকদের ধারণা, মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় করোনা পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতির উত্তরণ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানের ভাষ্য হলো, “ভাইরাসের সংক্রমণ তখনই কমবে যখন মানুষের শরীরে” হার্ড ইমিউনিটি ” তৈরি হবে অর্থাৎ শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। বিশেষজ্ঞরা আগেই বলেছিলেন, সমাজের এক অংশের মধ্যে যদি হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয় তাহলেই ভাইরাল স্ট্রেন ব্যাপক হারে সংক্রমিত হতে পারবে না। একটা পর্যায়ের পরে স্ট্রেন দুর্বল হতে শুরু করে। ইতিহাসও বিভিন্ন মহামারীর ক্ষেত্রে এমন সাক্ষ্য বহন করে। ইমিউনিটি বাড়াতে উৎসাহী-কৌতুহলী-আতঙ্কিত মানুষ ইতিমধ্যেই নানান ধরণের আয়ুর্বেদীয় এবং ভেষজসহ রান্নার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন মশলার গুণাগুণের কথাও উল্লেখ করেছেন। অবশ্য বিষয়গুলোর ওষুধি গুণাগুণ-অ্যান্টি অক্সিডেন্টের দিকটি হালে নতুন মাত্রা পেয়েছে। জনগণের কাছে বিপুলভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া ভেষজ উপাদানগুলো পুরোটা অবৈজ্ঞানিক নয় তবে ইমিউনিটির ক্ষেত্রে শতভাগ বিজ্ঞান নির্ভর বলা না হলেও সাধারণ মানুষ বিষয়টিকে ইতিবাচক অর্থেই গ্রহণ করেছেন এবং এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে বলে দাবি করা হয়। পিছিয়ে নেই আমরাও, মানুষের মন বলে কথা। ভেষজ মশলার ইতিবাচকতাকে কাজে লাগিয়ে এবার ইমিউনিটি বাড়াতে তৈরি হল “ইমিউনিটি পিঠা”। যশোরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আইডিয়ার কর্মীরা ডুমুর, কালিজিরা, আদা, অলিভ অয়েলসহ ১২ টি ওষুধি মশলার সমন্বয়ে তৈরি করলেন এই পিঠা (সমকাল, ৩ জুলাই )।
তবুও “সুপারস্প্রেডিং” ইভেন্টে ছড়ানো মরণব্যাধি কোভিড -১৯ তার মারণী শক্তিকে অধিকতর মিউটেশন প্রক্রিয়ায় বিস্তার ঘটিয়ে বিশ্বকে নতজানু-পর্যুদস্ত করে দিয়েছে। সায়েন্টিফিক আমেরিকার তথ্যমতে, আক্রান্ত ব্যক্তির উপসর্গ দেখা দেওয়ার পূর্বেই তার শ্বাসতন্ত্র থেকে নির্গত ড্রপলেটের মাধ্যমেই প্রাথমিকভাবে করোনা ছড়ায়। গবেষণা মতে, বদ্ধ পরিবেশে জীবাণু সংক্রমণ খোলা জায়গার চেয়ে ১৮ গুণ বেশি। বিশেষ করে নার্সিং হোম, ধর্মশালা, স্কুল কলেজ, ফুড প্রসেসিং প্লান্ট, শপিং সেন্টার, শ্রমিকদের ডরমিটরি, জেল-জাহাজ থেকেও সংক্রমণ ছড়ানোর ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা যায়। প্রশ্ন উঠেছে করোনার “সেকেন্ড ওয়েভ” নিয়েও; ভাইরাসের প্রথম পর্যায়ের ধাক্কা শেষে সংক্রমণ কমে গিয়ে আবার শক্তিশালী হয়ে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার হারকে চক্রাকারে ফিরে আসাকে ওয়েভ বা ঢেউ বলে। ইরানে আবার উল্লেখযোগ্যভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে মহামারীর “সেকেন্ড ওয়েভ” বা “দ্বিতীয় ঢেউ” হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন।
ওদিকে , চীনের বিশেষজ্ঞ দলের উপপ্রধান হুয়ালং ইয়ানের মতে, বাংলাদেশ সংক্রমণের চূঁড়ায় পৌঁছেছে কি না বলা কঠিন। চীনা বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশের জনগণের “অসচেতনতাকে” সংক্রমণের উর্ধ্বগতির জন্য দায়ী করেছেন। স্বাভাবিক দৃষ্টিতেও বিষয়টিকে এড়ানোর সুযোগ আমাদেরও নেই। তবে জীবন-জীবিকার সমন্বয় সাধনে যতোটুকু সামাজিক-শারীরিক দূরত্ব, স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন সেদিকটির প্রতি সাধারণ জনগণের চরম উদাসীনতাই পরিলক্ষিত হচ্ছে।
করোনাকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে সামনে আরো কিছু সময়, দিন। সুতরাং মনস্তাত্বিকভাবে নিজেদের সেভাবেই তৈরি করে এগিয়ে যেতে হবে। যেহেতু বিকল্প নেই। জীবনের প্রতিটি পর্যায়কে মোকাবিলা করতে হবে অসীম সাহসিকতা আর পরিপূর্ণ ধৈর্য সহকারে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে।
যতোদূর মনে হয়, সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় আলোর দ্যুতি অপেক্ষা করছে; আর সে আলোকচ্ছটা অচিরেই আশার ভুবনে স্বস্তি ফেরাবে। করোনা প্রতিরোধে ভ্যাকসিনে ইতিবাচক ফল পাওয়ার কথা জানাল মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ফাইজার এবং জার্মান কোম্পানি বায়ো এন টেক। “মেডআরএক্সআইভি” সাময়িকীতে ফাইজারের তৈরি ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল তথ্য প্রকাশ করা হয় (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩ জুলাই)।
মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনবিসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বে ১৪ টি ভ্যাকসিন নিয়ে মানব পরীক্ষা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিলকেন* ইন্সটিটিউটের তথ্যানুযায়ী, যেসব প্রতিষ্ঠানে ১৪ টি ভ্যাকসিন নিয়ে পরীক্ষা চলছে এর মধ্যে রয়েছে -ইনোভিও, ক্যানসিনো, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মর্ডানার মতো বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান।
পিছিয়ে নেই আমাদের বাংলাদেশ। আনুষ্ঠানিকভাবে এবং প্রায় আকস্মিকভাবে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড। সরকারের সহযোগিতা পেলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে এই ভ্যাকসিন বাজারজাত করতে সক্ষম হবেন বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাবৃন্দ। দশম দেশ হিসেবে ভারতের নাম উঠে এলেও ১১ তম দেশ হয়ে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের তালিকায় বিশ্বসভায় বাংলাদেশের এ সংযুক্তি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং আশাব্যঞ্জক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে যে বাংলাদেশ উন্নয়নের শীর্ষদেশে বিচরণের সুযোগ পেয়েছে, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সাফল্য এবং এর ফলপ্রসূ কার্যকারিতা প্রমাণিত হলে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে আমাদের এই দেশ।
ঠিক ততোদিন যতোদিন না আমরা সেই পরম প্রত্যাশিত কার্যকরী ভ্যাকসিনটি পাচ্ছি; আমাদের নিঃশব্দ লড়াইটা অদৃশ্য কোভিডের সাথে গভীর অন্তর্দৃষ্টি আর সংবেদনশীলতার সাথে চালিয়ে যেতে হবে। তাই, করোনার জালে বসত করেও সে জাল কেটে বেরিয়ে আসার *বর্মটা* তৈরির কৌশল জানাটা অতীব জরুরি। প্রয়োজন, সংকটে সংহত থেকে সাহসিকতার সাথে সার্বিক সচেতনতা।
লেখক: অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী,
দর্শন বিভাগ ও সাধারণ সম্পাদক, শিক্ষক পরিষদ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।