দখল-ভরাটে অস্তিত্ব হারাচ্ছে ঢাকার খাল

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

দখল ও ভরাটে অস্তিত্ব হারিয়েছে রাজধানীর অধিকাংশ খাল। যেগুলো কোনো মতে টিকে আছে সেগুলোরও প্রবাহ শক্তি নেই। তাই স্বাভাবিক বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় প্রধান প্রধান সড়ক ও অলিগলি। একটু বেশি বৃষ্টি হলে সড়কই বড় বড় খালে রূপ নেয়। নগরীর জীবনে নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ।

সোমবার ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। আর এতেই মিরপুর, মোহাম্মদপুর, আরামবাগ, মতিঝিল, পুরান ঢাকাসহ মহানগরীর বেশির এলাকার সড়কে হাঁটুপানি জমে যায়। অথচ ঢাকা ওয়াসার ভাষ্যমতে, ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হলে সামান্য সময়ের জন্য স্বল্প পরিমাণ জলাবদ্ধতা হতে পারে।

এরকম (১৯ মিলিমিটার) বৃষ্টিপাত হলে জলাবদ্ধতা হওয়ার কথা নয়। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন গত বছর ঘোষণা দিয়েছিলেন আগামী বছর কোনো জলাবদ্ধতা হবে না। কিন্তু সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন দেখছে না মানুষ।

ঢাকা শহরে একসময় ৬৫টি খাল ছিল। সময়ের আবর্তে সরকার, প্রভাবশালী মহল এবং সাধারণ মানুষের অযাচিত অসৎ ব্যবহারে বেশ কিছু খাল অস্তিত্ব হারিয়েছে। ২০০১ সালে ঢাকা ডিসি অফিস ও ঢাকা ওয়াসার জরিপমতে, ঢাকা শহরে ৪৩ খালের নাম জানা যায়।

এর মধ্যেও ১৭টির কোনো অস্তিত্ব নেই। বাকি ২৬টি খালের অস্তিত্ব থাকলেও দখল ও ভরাটের কারণে বেশির ভাগ খালের প্রবাহ নেই। কোনো খালের একাংশে প্রবাহ থাকলেও অন্য অংশ বন্ধ। এ কারণে কার্যকরভাবে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে ব্যর্থ হচ্ছে খালগুলো।

ঢাকা জেলা প্রশাসকের অফিস রাজধানী ও আশপাশ এলাকার খালের অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করে উচ্ছেদ অভিযান চালালেও সেসব খাল দখলমুক্ত রাখা সম্ভব হয়নি। অবৈধ দখলদার প্রতিরোধে মন্ত্রী পর্যায়ের কমিটি থাকলেও কার্যকর ফল আসেনি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বারবার খাল দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হলেও তা টেকসই ফল বয়ে আনেনি।

এ প্রসঙ্গে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন-খাল এবং ঢাকার আশপাশের নদীর সঙ্গে সংযোগ থাকতে হবে। দখল-ভরাটের কারণে এটা নষ্ট হয়েছে। এ কারণে বৃষ্টি হলেই ঢাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর উচিত সমস্যাগুলোর টেকসই সমাধানে কাজ করা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ড্রেন-খাল ও নদীর মধ্যে সংযোগ না থাকায় ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। পানি সংরক্ষণের আধারগুলো নষ্ট হওয়াও জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। এখন ড্রেন-বিদ্যমাণ খাল এবং চার পাশের নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে।

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হচ্ছে- নিচু এলাকা ভরাট করে ঢাকা শহরকে বালতিতে রূপান্তরিত করা। ড্রেন-খালগুলো নগরবাসী দখল-ভরাট করে ফেলছে। শত চেষ্টাতেও সেটা বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্যানেল মেয়র মো. ওসমান গণি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। তবে ডিএনসিসি নিজস্ব অবস্থান থেকে যতটুকু করা দরকার সেটুকু করছে।

জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের আংশিক দায়িত্ব ডিএসসিসির। সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের চেষ্টা করছি আমরা। ইতিমধ্যে শান্তিনগর, পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে গভীর ড্রেন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এবারের বর্ষায় এই দুটি স্পটে জলাবদ্ধতা হবে না।

ডিএসসিসি এলাকার খালগুলোও সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এ ছাড়া সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। আশা করি ধারাবাহিকভাবে এ কাজগুলো অব্যাহত থাকলে, জলাবদ্ধতার সমস্যা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

দখল-ভরাটের কবলে খাল : সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী বাসাবো খালের প্রস্থ ছিল ৬০ ফুট। আর এখন খালটির কোথাও প্রস্থ ১৫ ফুট, কোথাও ২০-২৫ ফুট। খালের ওপর টংঘর, দোকান-পাট গড়ে তুলে দখলদারিত্ব চালাচ্ছে অসাধু চক্র। অন্য দিকে গৃহস্থালির বর্জ্য, কম্বল, চেয়ার, মরা কুকুর, বিড়াল, মুরগিসহ বহুবিধ আবর্জনা খালে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

বেগুনবাড়ি খাল ও মহাখালী খালের প্রস্থ ছিল ৬০ ফুট। বর্তমানে এর প্রস্থ ২৫-৩০ ফুট। কোথাও কোথাও প্রস্থ ১৫-২০ ফুটেও নেমেছে। অস্থায়ী দখল ও ভরাটের পাশাপাশি এ খালে স্থায়ী দখলদারিত্বও চলছে। ১১০ ফুট প্রশস্ত রামচন্দ্রপুর খাল এখন ৫০-৬০ ফুটে ঠেকেছে। সেটাও সব জায়গায় নেই। সরেজমিন দেখা গেছে, খালে এত আবর্জনা ফেলা হয়েছে যে, অনায়াসে হেঁটে খাল পার হওয়া যায়।

এ ছাড়া খাল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বড় বড় অট্টালিকা। এসব প্রতিরোধ করার যেন কেউ নেই। ১০০ ফুট প্রশস্ত আবদুল্লাহপুর খাল এখন অর্ধেকে ঠেকেছে। কল্যাণপুর ১২০ ফুট খাল সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ ফুটে। বুড়িগঙ্গা খাল বা আদি চ্যানেল দিয়ে একসময় লঞ্চ, জাহাজ চললেও এখন খালটি প্রবাহ হারিয়েছে। দু’পাশে দখলের মহোৎসব চলছে। প্রভাবশালী গ্র“প জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দলিল তৈরি করে খালটি গ্রাস করে চলেছে। প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসব দখলে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে চলেছে।

গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক বৃষ্টির পানি ধারণের বড় উৎসহ হলেও দখল-ভরাটে সংকুচিত হচ্ছে এ উৎসটিও। পানি নিষ্কাশনের বড় এ উৎস রক্ষায় সরকার কয়েকটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ করলেও এখনও লেকটি দখল-ভরাটের কবল থেকে মুক্ত হয়নি।

মহানগরীর কাটাসুর, ইব্রাহিমপুর, বাউনিয়া, দিয়াবাড়ী, কল্যাণপুর, শাহজাদপুর খালের অস্তিত্ব থাকলেও এগুলো এখন দখলদারদের থাবায় সংকুচিত হয়ে পড়েছে। কালশির সাংবাদিক কলোনি খালে দখল ভরাট চরম সীমায় পৌঁছেছে। এ কারণে খালটি পানি নিষ্কাশনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। দখলদাররা গলা টিপে হত্যা করছে খালটিকে।

আর অসচেতন নগরবাসীও নিজেদের প্রয়োজনে খালটি ভরাট করে ফেলছে। এ কারণে সামান্য বৃষ্টিতে সাংবাদিক কলোনি খালের আশপাশের এলাকা বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। ভারি বর্ষণে সড়কে কোমর পানিও জমে যায়। অনেক ভবনের নিচতলায় পানি ওঠে।

সেগুনবাগিচা খালের ওপর কমলাপুর স্টেডিয়ামের দক্ষিণের সীমানা তৈরি করা হয়েছে। মাদারটেক ব্রিজ থেকে ত্রিমোহনী পর্যন্ত নন্দীপাড়া খালের ওপর অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ করা হয়েছে। মাণ্ডা ব্রিজ থেকে নন্দীপাড়া পর্যন্ত খালের প্রায় ৩৫টি স্পটে দখলদারিত্ব চলছে। এসব জায়গায় গজিয়ে উঠেছে টংঘর, দোকান, টিনের চালা ও বস্তি।

সেগুনবাগিচা খালের সঙ্গে যুক্ত আড়াই হাজার ফুট দীর্ঘ গোপীবাগ খাল ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। বেগুনবাড়ি খালের ভেতরে গড়ে উঠেছে বিজিএমইএ ভবন। চারটি খালের অংশ বিশেষ লেক হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও কার্যকর সংযোগ না থাকায় পানি নিষ্কাশনে ভালো ফল মিলছে না। ঝিগাতলা-শুক্রাবাদ খালটির ধানমণ্ডি অংশের নাম হয়েছে ধানমণ্ডি লেক।

সেগুনবাগিচা খালের নাম হয়েছে রমনা লেক। বেগুনবাড়ি খালের নাম হয়েছে হাতিরঝিল এবং আবদুল্লাহপুর খালের কিছু অংশ নিয়ে হয়েছে উত্তরা লেক। অন্যগুলো পেয়েছে নর্দমার আকৃতি। ঢাকা শহরের বহমান এসব খাল, লেক, ড্রেনের সাথে আশপাশের নদীর সংযোগ না থাকায় সামান্য বৃষ্টির পানিও বের হতে পারছে না।

সংশ্লিষ্টদের মতে, ষাটের দশকেও রাজধানীর খালগুলো মানবদেহের শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে ছিল। বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-বালু-শীতলক্ষ্যা থেকে সরাসরি এসব খাল ব্যবহার করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চলাচল করত মানুষ। ওই সময় রাজধানীতে কোনো জলাবদ্ধতা ছিল না, পরিবেশ ছিল স্বাস্থ্যসম্মত। অর্ধশত বছরের ব্যবধানে দখল-ভরাটে অর্ধেকের বেশি খাল হারিয়ে গেছে। ফলে তীব্র জলজট, জলাবদ্ধতা এবং চরম পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে রাজধানী ঢাকা।