দক্ষিণাঞ্চলের পলিথিন সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিলো ঝালকাঠির এসপি, ছাড় পায়নি পুলিশ-ছাত্রলীগ

লেখক:
প্রকাশ: ৫ years ago

পরিবেশ রক্ষায় সারাদেশে পলিথিন উৎপাদন, আমদানী ও বাজারজাতকরণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানছে না অনেকেই। বরংছ দক্ষিণাঞ্চলে পলিথিন আমদানী ও বাজারজাতকরণে সক্রিয় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। শুধু অল্পদিন নয়, বছরের পর বছর ধরে এই ব্যবসা চলায় দিনে দিনে সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পরেছেন স্থানীয় পুলিশ, ছাত্রলীগ, কথিত সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী।

তবে ঝালকাঠি পুলিশ সুপার ফাতিহা ইয়াসমিন ও সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এমএম মাহামুদ হাসানের জিরোটলারেন্সে সেই সিন্ডিকেট প্রকাশ্যে এলো।

জানা গেছে, ঢাকায় উৎপাদনের পর নির্ধারিত কয়েকটি কার্ভাড ভ্যানে করে দক্ষিণাঞ্চলের পলিথিন সিন্ডিকেটের সদর দপ্তর ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া থেকে খেঁজুর তলা নামক স্থানের মধ্যে পলিথিনগুলো আনলোড হতো। তারই ধারাবাহিকতায় ৯ মে রাতে একটি পলিথিনবাহী কার্ভাড ভ্যান আটক করে স্থানীয়রা। খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত হন নলছিটি থানার কতিপয় পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রায় লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেয় পলিথিনের চালানটি। পরবর্তীতে সেই চালান ওই ইউনিয়নের ছাত্রলীগ নেতার অংশগ্রহণে জব্দ করে আত্মসাত করা হয়। এ ঘটনা জানাজানি হলে প্রকাশ্যে আসে সিন্ডিকেটটি। তড়িৎ গতিতে ব্যবস্থা নেন জেলা পুলিশ প্রধান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরিশাল নগরীর রূপতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে নলছিটি উপজেলার খেঁজুর তলা নামক স্থান পর্যন্ত সড়কের আশপাশে প্রশাসন, ক্ষমতাশীন দলের নেতা, কথিত সাংবাদিকের মদদে পলিথিন আনলোড হতো। এখন থেকে পর্যায়ক্রমে তা ছড়িয়ে পরতো বিভাগের ৬ জেলায়। সূত্র বলছে, দপদপিয়া এলাকায় পলিথিন সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সিরাজ মোল্লা, সহযোগী আল আমিন খান, বাকেরগঞ্জ উপজেলার পাদ্রীশিবপুর ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের আবুল কামাল। এদের পলিথিনের চালান আনতে সহায়তা করতো নলছিটি থানার এসআই রাসেল ও এএসআই শহিদুল ইসলাম। এছাড়াও ওই উপজেলার কয়েকজন কথিত সাংবাদিক ওই কাজে সহায়তা করতো।

নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, একজন ট্রান্সপোট ব্যবসায়ীর হাত ধরে এই অঞ্চলে পলিথিন সিন্ডিকেটের বিস্তার ঘটে। রাষ্ট্রনিষিদ্ধ ও পরিবেশ ক্ষতিকর পলিথিন আমদানী ও এই অঞ্চলের বিভিন্ন ক্ষুদ্ধ ব্যবসায়ীদের কাছে বাজারজাতকরণের ওপর ভিত্তি করে দুটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। এই সিন্ডিকেটের একটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন দপদপিয়া ইউয়িনের ছাত্রলীগের সভাপতি সিরাজ মোল্লা ও অপরটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বাকেরগঞ্জ উপজেলার পাদ্রীশিবপুর ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের আবুল কামাল।

সম্প্রতি দুই সিন্ডিকেটের মধ্যে বৈরিতা শুরু হলে পলিথিনের আটকের খবর পাওয়া যায়। ঝালকাঠির পুলিশ জানিয়েছে, পলিথিন সিন্ডিকেটের সাথে আইনভঙ্গ করে জড়িয়ে পরায় নলছিটি থানার এসআই রাসেল ও এএসআই শহিদুল ইসলামকে ক্লোজড করে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় অধিকতর তদন্ত চলছে। পাশাপাশি যারাই আইনভঙ্গ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ৯ মে আবুল কালামের পলিথিন বোঝাই কার্ভাড ভ্যান আটক করে ৯৮ হাজার টাকা নিয়ে অবৈধপণ্যবাহী গাড়িটি ছেড়ে দেয়ায় নলছিটি থানার ওই দুই পদস্থ পুলিশ সদস্য শাস্তির আওতায় এসেছেন। এদিকে পলিথিন বোঝাই কার্ভাড ভ্যানটি আটকে দপদপিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সিরাজ মোল্লা পলিথিন আত্মসাত করার ঘটনার সত্যতা পেয়েছে গোয়েন্দা বিভাগ।

একারণে আত্মরক্ষার্থে সমঝোতার জন্য দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছে পলিথিন সিন্ডিকেট। গতকাল দপদপিয়া ও বাকেরগঞ্জ উপজেলার পাদ্রীশিবপুরে সরেজমিনে খোঁজ করে জানা গেছে পলিথিন সিন্ডিকেট পরিচালনাকারীরা এলাকা ছাড়া। নলছিটি থানার ওসি শাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, এ ঘটনায় থানায় কেউ অভিযোগ করেনি। এ বিষয়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা সিরাজ মোল্লা মুটোফোনে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এই সিন্ডিকেটের সাথে আমি কখনোই জড়িত ছিলাম না। আমি পলিথিন ব্যবসা নয়, পোল্ট্রি ব্যবসা করি। যারা এই অভিযোগ আসছে, তারা আমাকে হেয় করার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে। পলিথিন সিন্ডিকেট পরিচালনাকারী আবুল কালামের পরিবার জানিয়েছে, ঘটনার পর অনেক লোক কয়েকবার বাড়িতে এসে হুমকি দেয়ায় বৃহস্পতিবার এলাকা ছেড়ে ঢাকা চলে গেছেন আবুল কালাম।

আইন কি বলছে?
‘পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সামগ্রী উৎপাদন, বিক্রয় ইত্যাদির উপর বাধা-নিষেধ’ শীর্ষক আইনের ৬(ক) ধারায় বলা হয়, ‘সরকার মহাপরিচালকের পরামর্শ বা অন্য কোনোভাবে যদি সন্তুষ্ট হয় যে, সকল বা যেকোনো ধরনের পলিথিন শপিং ব্যাগ বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরি অন্য কোনো সামগ্রী বা অন্য যেকোনো সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তাহলে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে সারা দেশে বা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় এ ধরনের সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার বা প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত শর্তাধীনে ওই সকল কার্যক্রম পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশ জারি করতে পারবে। এবং ওই নির্দেশ পালনে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি বাধ্য থাকবেন’।

যদি এই নির্দেশ অমান্য করে সরকার নির্ধারিত পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণে প্রথম অপরাধের দায়ে অনধিক ২ (দুই) বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ২ (দুই) লাখ টাকা অর্থদন্ড (জরিমানা) বা উভয় দন্ড এবং পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন ২ (দুই) বছর, অনধিক ১০ (দশ) বছরের কারাদন্ড বা অন্যূন ২ (দুই) লাখ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদন্ড (জরিমানা) বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন অপরাধীরা’।

বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের দায়ে অনধিক ১ (এক) বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদন্ড (জরিমানা) বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে।

‘পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের দায়ে অন্যূন ২ (দুই) বছর, অনধিক ১০ (দশ) বছরের কারাদন্ড বা অন্যূন ২ (দুই) লাখ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদন্ড (জরিমানা) বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন অপরাধীরা’।