থমকে আছে নাসা প্রকৌশলীর ১২ হাজার টাকার ল্যাপটপ তৈরির স্বপ্ন

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী হাসান রহমান। প্রায় চার বছর আগে ছুটিতে দেশে আসেন। সেসময় তার বন্ধু তাকে সংক্ষিপ্ত সফরে গাজীপুরের বাশবাড়ির একটি স্কুলে নিয়ে যান। স্কুলের শিক্ষার্থীরাও নাসার প্রকৌশলীর সঙ্গে দেখা করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।

কিন্তু নাসা প্রকৌশলী স্কুলের শিশুদের প্রযুক্তি থেকে পিছিয়ে পড়া দেখে হতাশ হয়ে যান। এরপর থেকেই তার মাথায় চিন্তা আসে কীভাবে কম দামে শিক্ষার্থীদের জন্য ল্যাপটপ তৈরি করা যায়। তারপর তিনি ‘তালপাতা’ নামে একটি স্বল্পমূল্যের ল্যাপটপ তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। যেমন কথা তেমন কাজ, তিনি একটি পরিকল্পনা করেন এবং কাজ শুরু করে দেন। হাসান রহমান ঠিক করেন, শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি ১২ হাজার টাকার মধ্যে ল্যাপটপ তৈরি করবেন।

গেলো বছরের অক্টোবরে তার তৈরি ল্যাপটপ ‘তালপাতা’ বাজারে আসে। এর আগে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে স্থাপন করেন কারখানা। তবে সামনে এসেছে নানা প্রতিবন্ধকতা। এখন এর উৎপাদনে মুখ থুবড়ে পড়েছে। যাত্রার এক মাসের মাথায় হোঁচট খেয়েছে দেশে তৈরি এই ল্যাপটপের উৎপাদন। কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চমূল্যের শুল্কের কারণে আপাতত উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

তারা শিক্ষার্থীদের জন্য ১২ হাজার টাকা দামের ল্যাপটপ বানালেও এর বাইরে ২৫ থেকে এক লাখ টাকা দামের উচ্চ ফিচার সমৃদ্ধ তালপাতা ল্যাপটপও তৈরির কথা ছিল প্রতিষ্ঠানটির।

কম দামে ভালো ফিচারের ল্যাপটপ দিতেই এমন উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান রহমান। তিনি ১২ হাজার টাকায় একটি ৩৬০ ডিগ্রি মাল্টি টাচ স্ক্রিন ফোল্ডেবল ল্যাপটপ ডিজাইন করেন। এতে তিন বছরের গ্যারান্টি রয়েছে। আছে আগুন ও পানি নিরোধ ব্যবস্থা। আট ঘণ্টা ব্যাটারি ব্যাকআপ, ১২৮ জিবি স্টোরেজ ও ৮ জিবি র্যামসহ এটির আকার ১১ দশমিক ৬ ইঞ্চি। এ বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে এটি উইন্ডোজ ও লিনাক্স-ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেমে চলতে পারে এবং একটি ইন্টেল এন৪০০০ প্রসেসর থাকতে পারে।

তালপাতা ল্যাপটপ তৈরি করতে তিনি হাই-টেক পার্কের কর্তৃপক্ষের কাছে যান। কারণ তিনি তাদের বিজ্ঞাপন দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলেন। এতে বলা হয়েছিল, কারখানার জন্য প্রতি বর্গফুটের মাসিক ভাড়া ১০ টাকা, যেখানে গুলশানের মতো জায়গায় প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ১২০ টাকা।

হাইটেক পার্ক একটি ওয়ান-স্টপ সলিউশন বলে দাবি করে, যা একটি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির জন্য ট্যাক্স, ভ্যাট ও শুল্ক ছাড় দেয়। পরিকল্পনা মাফিক হাসান রহমান তালপাতাকে চূড়ান্ত রূপ দিতে বিদেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করেন। তখন থেকেই ডেটাসফ্ট ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড অ্যাসেম্বলি ইনকরপোরেশন লিমিটেড (Datasoft Manufacturing and Assembly Inc Limited) বানিয়ে ল্যাপটপ তৈরির কাজ শুরু করেন। এরপরই বাধে বিপত্তি।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান রহমান বলেন, ‘প্রযুক্তি ডিভাইসগুলোর চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে আমি ল্যাপটপটি ক্যান্ডির মতো বিক্রির আশা করেছিলাম। কিন্তু প্রায় দুই বছর ধরে আমি বাল্ক প্রোডাকশনে না গিয়ে যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি, তা কমাতে সংগ্রাম করে যাচ্ছি।’

 

তিনি জানান, শুরুতে বন্দরে ‘তালপাতা’র কাঁচামাল আসার পর জানতে পারেন, তাকে ৪৭ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। অথচ তিনি জানতেন, তাকে ১ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। এরপর তালপাতার বাজারমূল্য তার শুল্কের কারণে দ্বিগুণ হয়ে যায়।

তিনি বলেন, ‘বাস্তবে, হাইটেক পার্কের সব প্রতিশ্রুতি সত্য ছিল না। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, শুধু কাঁচামাল আমদানির জন্য আমাকে এত শুল্ক দিতে হবে। যেখানে অন্যদের ল্যাপটপ অ্যাসেম্বলির জন্য মালামাল আমদানিতে ৯ শতাংশ শুল্ক নেওয়া হচ্ছে। এটা কী ধরনের নীতি? এই ধরনের নীতি কীভাবে ব্যবসায়ীদের তাদের ব্যবসা বাড়াতে উৎসাহিত করতে পারে?’

তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তাকে জানিয়েছে, তার কারখানা এনবিআর ও বুয়েটের বিশেষ কমিটি দ্বারা নিরীক্ষিত ও প্রত্যয়িত না হওয়ায় তিনি ১ শতাংশ শুল্ক সুবিধা নিতে পারবেন না। এছাড়া সংস্থাটি জানায়, ইনপুট, আউটপুট সব কিছু পরিমাপের পর তার সংস্থাকে সনদপত্র দেওয়া হবে। প্রতিটি অডিটে খরচ হবে আড়াই লাখ টাকা। সনদের পরে তিনি যন্ত্রপাতির জন্য ১ শতাংশ শুল্ক সুবিধা পাবেন, তবে কাঁচামালে নয়।

হাসান রহমান বলেন, ‘হাইটেক আমাকে এসব নীতি সম্পর্কে আগে জানায়নি। যেহেতু আমি সফলভাবে হাইটেক দ্বারা প্রত্যয়িত হয়েছি, আমি ধরে নিয়েছিলাম যেসব অফিসিয়াল প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়েছে। আজ এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আমাদের ল্যাপটপ তৈরির কাজ থমকে আছে।’

বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকর্ণ কুমার ঘোষ বলেন, ‘আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। যদিও এটা আমার করার কথা না, তবুও আমি এনবিআরকে অনুরোধ করেছি, তাদের একটা সমাধান খুঁজতে সাহায্য করার জন্য।’

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব (কাস্টমস, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড অ্যাগ্রিমেন্ট) খায়রুল কবির মিয়া  বলেন, ‘বাংলাদেশ হাইটেক কর্তৃপক্ষ যদি তাদের সহযোগিতা না করে থাকে তাহলে এটা আমাদের দোষ নয়। আমরা আমাদের দায়িত্বের প্রতি সৎ ছিলাম। তারপরও যদি কারও কোনো পরামর্শ থাকে তাহলে তারা জানাতে পারেন। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আমরা সংলাপের জন্য উন্মুক্ত।’